ছয়দফা কর্মসূচিকে বা আন্দোলনকে কেন বাঙালির ম্যাগনাকার্টা বলা হয়

ছয়দফা কর্মসূচিকে বা আন্দোলনকে কেন বাঙালির ম্যাগনাকার্টা বলা হয়

Degree 1st Year Suggestion 2025

খাদ্য জালক কি? খাদ্য চক্রের বর্ণনা দাও

১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক লাহোরে উত্থাপিত ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি (Six Point Movement) বাঙালির জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় দলিল। দীর্ঘকাল ধরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাতে শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক মুক্তির দাবি নিয়ে এই কর্মসূচি প্রণীত হয়েছিল। এর গুরুত্ব ও প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী ছিল যে, এটিকে ‘বাঙালির ম্যাগনাকার্টা’ বা ‘বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই নিবন্ধে আমরা আলোচনা করব কেন ছয় দফা কর্মসূচিকে বাঙালির ম্যাগনাকার্টা বলা হয় এবং এর মূল তাৎপর্য কী ছিল।

ম্যাগনাকার্টা কী এবং ছয় দফার সাথে এর সাদৃশ্য

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বুঝতে প্রথমে জানতে হবে ম্যাগনাকার্টা (Magna Carta) কী।

১২১৫ সালের ১৫ জুন ইংল্যান্ডের রাজা জন (King John)-কে সেদেশের ব্যারনরা বাধ্য করে একটি সনদ বা ‘চার্টার অব রাইটস’ স্বাক্ষর করতে, যা ইতিহাসে ম্যাগনাকার্টা নামে পরিচিত। এই দলিলটি রাজার নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে সীমিত করে এবং জনগণের আইনগত অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। এটি ছিল প্রজাদের অধিকার আদায়ের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ লিখিত দলিল, যা পরবর্তীকালে বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংবিধানের ভিত্তি স্থাপন করে।

ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচিও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের অধিকার ও স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার এক মহাসনদ। যেমন ম্যাগনাকার্টা ইংল্যান্ডের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল, তেমনি ছয় দফা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন-শোষণ থেকে বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির দিশা। এই মৌলিক সাদৃশ্যের কারণেই ছয় দফাকে ‘বাঙালির ম্যাগনাকার্টা’ বলা হয়।


ছয় দফা: বাঙালির ম্যাগনাকার্টা বলার মূল কারণ

ছয় দফা কর্মসূচিকে বাঙালির মুক্তির সনদ বা ম্যাগনাকার্টা বলার পেছনে সুনির্দিষ্ট কিছু ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। নিচে ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বা তাৎপর্য উল্লেখ করা হলো:

১. বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক (Self-Identity): ছয় দফা বাঙালি জাতিকে তাদের আত্মপরিচয়ের সন্ধান দেয় এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ সত্ত্বেও দেশের আপামর জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে।

২. স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তি (Foundation of Autonomy): এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার একটি সুনির্দিষ্ট ও বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো

৩. জনগণের অধিকারের দলিল (Charter of People’s Rights): ম্যাগনাকার্টার মতো, ছয় দফা ছিল শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শোষিত জনগণের অধিকার আদায়ের প্রথম লিখিত ও সুস্পষ্ট দলিল

৪. অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ (Elimination of Economic Disparity): ছয় দফার প্রধান দাবিগুলো (যেমন মুদ্রা, কর ও বৈদেশিক বাণিজ্য সংক্রান্ত দফা) পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘকালীন অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধ করার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল।

৫. স্বাধীনতা অর্জনের সোপান (Stepping Stone to Independence): বঙ্গবন্ধু নিজেই এটিকে “স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য সাঁকো” বলে অভিহিত করেন, যা কার্যত স্বাধীনতার পথে প্রথম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা।

৬. গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রকাশ (Expression of Democratic Movement): আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণের মানসিকতা গঠনে ছয় দফাকে ব্যবহার করে, যা গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক অধিকারের প্রতি বাঙালির অবিচল আস্থাকে প্রতিফলিত করে।

৭. সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন (Support from All Strata): ভাষা আন্দোলন বা শিক্ষা আন্দোলনের মতো শুধু শিক্ষিত বা প্রগতিশীল শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, ছয় দফা ছাত্র, জনতা, শ্রমিক ও পেশাজীবী—সকল স্তরের মানুষের মুক্তির আন্দোলনে পরিণত হয়।

৮. ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা (Establishing Unity): ছয় দফা কর্মসূচি পূর্ব বাংলার মানুষকে এক অভূতপূর্ব ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে, যা পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের দিকে চালিত করে।

৯. পশ্চিম পাকিস্তানের ভিত নাড়িয়ে দেওয়া (Shaking the Foundation of Pakistan): পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এটিকে “বিচ্ছিন্নতার দলিল” হিসেবে দেখত, কারণ তারা বুঝেছিল যে ছয় দফা বাস্তবায়িত হলে পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটবে।

১০. সাংবিধানিক কাঠামো পরিবর্তন (Constitutional Framework Change): প্রথম দফায় লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রীয় ও সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার রাষ্ট্রসংঘে পরিণত করার দাবি ছিল, যা প্রচলিত শাসনতান্ত্রিক কাঠামোকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিত।

১১. কেন্দ্রীয় ক্ষমতা সীমিতকরণ (Limiting Central Power): দ্বিতীয় দফায় প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি বাদে অন্যান্য সকল ক্ষমতা অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে ন্যস্ত করার দাবি কেন্দ্রীয় সরকারের স্বৈরাচারী ক্ষমতাকে খর্ব করত।

১২. নির্বাচনী ম্যান্ডেট (Electoral Mandate): ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে, যেখানে ছয় দফা ছিল তাদের মূল নির্বাচনী ইশতেহার। এটি প্রমাণ করে যে ছয় দফা বাঙালির সর্বসম্মত মুক্তির ম্যান্ডেট ছিল।

১৩. আইয়ুব খানের দমননীতি ও গণ-অভ্যুত্থান (Ayub’s Suppression and Mass Uprising): ছয় দফার পক্ষে আন্দোলন দমন করতে আইয়ুব খানের সামরিক সরকারের দমননীতি (যেমন ৭ জুনের হত্যাকাণ্ড) এবং পরবর্তীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, বাঙালিকে আরও বেশি বিপ্লবী করে তোলে এবং ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের জন্ম দেয়।

১৪. মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রামাণ্য দলিল (Document of the Desire for Liberation): ছয় দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, স্বাধিকারের দাবি এবং বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার স্বপ্নের এক প্রামাণ্য ও বিস্তারিত দলিল

১৫. আন্তর্জাতিক অনুপ্রেরণা (International Inspiration): প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন যে, এই ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি শুধু বাঙালির মুক্তির সনদই নয়, বরং বিশ্বের নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের আন্দোলনের প্রেরণার উৎস


ছয় দফা কর্মসূচির মৌলিক দাবিগুলো (The Six Demands)

ছয় দফা কর্মসূচিকে অনুধাবন করতে হলে এর মৌলিক দাবিগুলো জানা অপরিহার্য:

১ম দফা: শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি: ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান একটি ফেডারেশন হবে। সরকার হবে সংসদীয় পদ্ধতির এবং আইন পরিষদ হবে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ও সার্বভৌম।

২য় দফা: কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা: কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কেবল প্রতিরক্ষা (Defence)পররাষ্ট্র (Foreign Affairs) বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে। অবশিষ্ট সকল ক্ষমতা অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে ন্যস্ত থাকবে।

৩য় দফা: মুদ্রা ও অর্থ বিষয়ক ক্ষমতা: পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সহজে বিনিময়যোগ্য দুটি পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। অথবা, একটি মুদ্রা ব্যবস্থা চালু থাকলে পুঁজি পাচার রোধে সাংবিধানিক ব্যবস্থা নিতে হবে এবং দুই অঞ্চলে দুটি স্বতন্ত্র রিজার্ভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৪র্থ দফা: কর বা রাজস্ব বিষয়ক ক্ষমতা: সকল প্রকার কর বা রাজস্ব ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকার তার ব্যয় নির্বাহের জন্য আঞ্চলিক সরকারের তহবিলের একটি নির্দিষ্ট অংশ পাবে।

৫ম দফা: বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা: দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পৃথক হিসাব রাখতে হবে। আঞ্চলিক সরকারগুলো নিজ নিজ অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারের এবং বৈদেশিক বাণিজ্য চুক্তি করার ক্ষমতা রাখবে।

৬ষ্ঠ দফা: আঞ্চলিক মিলিশিয়া বা আধাসামরিক বাহিনী গঠন: আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষার জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে নিজস্ব সামরিক বা আধাসামরিক বাহিনী (যেমন মিলিশিয়া বা প্যারা-মিলিটারি ফোর্স) গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে এবং নৌবাহিনীর সদর দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে।

উপসংহার:

ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি ছিল বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক জবাব। এটি কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী উদ্যোগ ছিল না, বরং বিদ্যমান আইনি ও রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার একটি প্রামাণ্য পথরেখা। এই কর্মসূচির মাধ্যমেই বাঙালি জাতি তাদের স্বাধিকারের দাবিকে স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত করার সাহস ও প্রেরণা পেয়েছিল। তাই এটিকে কেবল একটি রাজনৈতিক দাবি বা আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে দেখলে ভুল হবে, এটি ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির মহাসনদ—ঠিক যেমনটি ইউরোপের ইতিহাসে ম্যাগনাকার্টাছয় দফা আন্দোলন থেকেই জন্ম নেয় এক স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন, যা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেয়।

Similar Posts

Leave a Reply