সমাজবিজ্ঞান ৬ষ্ঠ পত্র সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন সাজেশন
সমাজবিজ্ঞান ৬ষ্ঠ পত্র সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন সাজেশন
১. নগরায়ণ, সুশাসন ও সুশীল সমাজ কী?
নগরায়ণ (Urbanization)
নগরায়ণ একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কোনো অঞ্চলের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ স্থায়ীভাবে গ্রামীণ জীবনধারা ত্যাগ করে শহরাঞ্চলে স্থানান্তরিত হয় এবং এর ফলস্বরূপ শহুরে জনসংখ্যা ও এলাকার প্রসারণ ঘটে।
নগরায়ণের মূল দিকসমূহ:
- জনসংখ্যার বৃদ্ধি: শহরের ভৌগোলিক সীমানার তুলনায় জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং বৃদ্ধি বেশি হয়।
- জীবনযাত্রার পরিবর্তন: মানুষের জীবিকা প্রধানত কৃষি থেকে সরে শিল্প, ব্যবসা ও সেবা খাতে স্থানান্তরিত হয়।
- অবকাঠামো ও সমাজ: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মতো শহুরে অবকাঠামো গড়ে ওঠে এবং জটিল সামাজিক কাঠামো তৈরি হয়।
- সাংস্কৃতিক পরিবর্তন: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব বৃদ্ধি পায় এবং ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ক শিথিল হয়।
সুশাসন (Good Governance)
সুশাসন হলো এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, জনগণের অংশগ্রহণ, আইনের শাসন, দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করা হয়। সুশাসন একটি দেশকে স্থিতিশীলতা, ন্যায়বিচার এবং টেকসই উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে অপরিহার্য।
সুশাসনের প্রধান উপাদানসমূহ:
- জবাবদিহিতা: সরকার তার সিদ্ধান্তের জন্য জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।
- স্বচ্ছতা: সরকারের কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
- আইনের শাসন: জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সবাই আইনের চোখে সমান হবে।
- জনগণের অংশগ্রহণ: সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সকল স্তরের জনগণের মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
- দক্ষতা: সম্পদের কার্যকর ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা।
সুশীল সমাজ (Civil Society)
সুশীল সমাজ হলো রাষ্ট্র (সরকার) এবং পরিবার বা বাজার অর্থনীতির বাইরে গড়ে ওঠা স্বেচ্ছাসেবী, অরাজনৈতিক ও অলাভজনক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সমষ্টি। এগুলি মূলত জনগণের স্বার্থ রক্ষায়, সরকারের ওপর নজরদারিতে এবং সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কাজ করে।
সুশীল সমাজের উদাহরণ:
- এনজিও (NGO), মানবাধিকার সংস্থা, পেশাজীবী সমিতি (যেমন: শিক্ষক সমিতি, আইনজীবী সমিতি), পরিবেশবাদী সংগঠন ও গণমাধ্যম।
২. গ্রামীণ অর্থনীতি কাকে বলে? অথবা, গ্রামীণ সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো কী?
গ্রামীণ অর্থনীতি (Rural Economy)
গ্রামীণ অর্থনীতি বলতে সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝায় যা প্রধানত কৃষি ও কৃষিজাত কার্যকলাপের ওপর নির্ভরশীল। এই অর্থনীতিতে প্রাকৃতিক সম্পদ (যেমন: ভূমি, নদী, বন) ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার ওপর গ্রামীণ জনপদের সিংহভাগ মানুষের জীবিকা ও আয় নির্ভর করে। গ্রামীণ অর্থনীতি সাধারণত কম শিল্পায়িত এবং এর বাজার সীমিত হয়।
গ্রামীণ সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
গ্রামীণ সমাজের জীবন, সম্পর্ক ও কাঠামোকে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো দ্বারা চিহ্নিত করা যায়:
- কৃষিভিত্তিক জীবন: গ্রামীণ সমাজের প্রধান জীবিকা হলো কৃষি (ফসল উৎপাদন, পশুপালন, মৎস্য চাষ)। অর্থনীতি এবং জীবনধারণ সরাসরি ভূমির মালিকানা ও কৃষি উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল।
- প্রকৃতির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক: গ্রামীণ মানুষ জীবন ধারণের জন্য আবহাওয়া, নদী ও মাটির মতো প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল থাকে।
- জনসংখ্যার ঘনত্ব কম: শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব সাধারণত কম হয়।
- সহজ ও স্থিতিশীল জীবন: জীবনযাত্রা সাধারণত সরল, স্থিতিশীল এবং পরিবর্তনশীলতার হার কম থাকে। দৈনন্দিন কাজগুলো প্রথাগত নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হয়।
- গোষ্ঠী চেতনা ও সামাজিক সংহতি: ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের চেয়ে আমরা বোধ প্রবল। জ্ঞাতি সম্পর্ক ও প্রতিবেশীদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সংহতি বেশি লক্ষ্য করা যায়।
- প্রাথমিক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ: সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রধানত পরিবার, জ্ঞাতি সম্পর্ক, প্রথা, ধর্ম ও জনমতের মাধ্যমে ঘটে। আনুষ্ঠানিক আইনের চেয়ে অনানুষ্ঠানিক চাপ বেশি কার্যকর।
- জ্ঞাতি সম্পর্কের গুরুত্ব: রক্তের সম্পর্ক, বিবাহ বা বংশের মাধ্যমে সৃষ্ট জ্ঞাতি সম্পর্ক এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং সামাজিক কাঠামোকে দৃঢ় রাখে।
৩. এথনিক গোষ্ঠী ও জ্ঞাতি সম্পর্কের সংজ্ঞা দাও।
এথনিক গোষ্ঠী (Ethnic Group)
এথনিক গোষ্ঠী বা নৃগোষ্ঠী হলো একদল মানুষ যারা নিজেদের মধ্যে একটি সাধারণ বংশ, সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য বা ভৌগোলিক উৎসের কারণে একাত্মতা অনুভব করে এবং এই অভিন্ন পরিচয়ের ভিত্তিতে অন্যদের থেকে নিজেদেরকে একটি স্বতন্ত্র সামাজিক গোষ্ঠী হিসেবে দেখে।
মূল উপাদান:
- ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
- অভিন্ন ভাষা বা উপভাষা
- নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান
- একই ভৌগোলিক অঞ্চল বা আদিভূমি সম্পর্কে সচেতনতা
জ্ঞাতি সম্পর্ক (Kinship)
জ্ঞাতি সম্পর্ক হলো রক্ত, বিবাহ বা দত্তকের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সামাজিক সম্পর্ক, যা সমাজের সদস্যদের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন এবং পারিবারিক কাঠামো তৈরি করে। এটি সমাজবিজ্ঞানের একটি মৌলিক ধারণা, যা সমাজে উত্তরাধিকার, সম্পত্তি, অধিকার, দায়িত্ব এবং বিবাহ-সম্পর্কিত নিয়মাবলি নির্ধারণ করে।
জ্ঞাতি সম্পর্কের প্রকারভেদ:
- রক্তের সম্পর্ক (Consanguineal Kinship): বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি—অর্থাৎ রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ সম্পর্ক।
- বৈবাহিক সম্পর্ক (Affinal Kinship): বিবাহের মাধ্যমে সৃষ্ট সম্পর্ক, যেমন: শ্বশুর-শাশুড়ি, শালা-শালি ইত্যাদি।
- কল্পিত সম্পর্ক (Fictitious Kinship): ধর্মীয় বা সামাজিক প্রথা দ্বারা সৃষ্ট সম্পর্ক, যেমন: ধর্ম ভাই-বোন, গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক।
৪. জাতিবর্ণ ও শ্রেণির মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ কর।
| পার্থক্যসূচক ভিত্তি | জাতিবর্ণ (Caste) | শ্রেণি (Class) | 
| ভিত্তি | জন্ম। ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান জন্মসূত্রে নির্ধারিত হয়। | অর্থনৈতিক অবস্থা ও অর্জন। ব্যক্তির অবস্থান তার আয়, সম্পত্তি, শিক্ষা, দক্ষতা ও পেশা দ্বারা নির্ধারিত হয়। | 
| প্রকৃতি | এটি একটি বদ্ধ (Closed) স্তরবিন্যাস। এক জাতিবর্ণ থেকে অন্যটিতে যাওয়া অসম্ভব বা কঠিন। | এটি একটি মুক্ত (Open) স্তরবিন্যাস। ব্যক্তি তার চেষ্টা ও অর্জনের মাধ্যমে শ্রেণি পরিবর্তন করতে পারে (সামাজিক গতিশীলতা)। | 
| পরিবর্তনশীলতা | অপরিবর্তনীয়/স্থির। জীবনের কোনো পর্যায়ে জাতিবর্ণ পরিবর্তন করা যায় না। | পরিবর্তনশীল/গতিশীল। শিক্ষা বা পেশাগত উন্নতির মাধ্যমে নিম্ন শ্রেণি থেকে উচ্চ শ্রেণিতে যাওয়া সম্ভব। | 
| অন্তর্বিবাহের নিয়ম | জাতিবর্ণের মধ্যে বিবাহ বাধ্যতামূলক (Endogamy)। নিজের জাতিবর্ণের বাইরে বিবাহ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। | বিবাহের ক্ষেত্রে শ্রেণির কোনো কঠোর নিয়ম নেই, তবে সাধারণত একই শ্রেণির মধ্যে বিবাহ হয়। | 
| অর্থনৈতিক সম্পর্ক | ঐতিহ্যবাহী এবং আচার-অনুষ্ঠান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। | সম্পর্কগুলো মূলত শ্রমের বিনিময়, বেতন এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। | 
| উদাহরণ | হিন্দু সমাজের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। | উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত (শ্রমজীবী শ্রেণি)। | 
৫. প্যারোল ও প্রবেশনের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ কর।
| পার্থক্যসূচক ভিত্তি | প্যারোল (Parole) | প্রবেশন (Probation) | 
| সময়কাল | সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীকে সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে একটি নির্দিষ্ট শর্তে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া। | আদালত অপরাধীকে কারাদণ্ডের পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সমাজে থেকে সংশোধনের সুযোগ দেয়। | 
| অবস্থান | অপরাধী প্রথমে কারাগারে সাজা ভোগ করার পর প্যারোলে মুক্তি পায়। | অপরাধীকে কারাগারে যেতেই হয় না, সে প্রথম থেকেই সমাজে থেকে সংশোধনের চেষ্টা করে। | 
| লক্ষ্য | সাজার শেষ পর্যায়ে অপরাধীকে ধীরে ধীরে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা এবং পুনর্বাসন করা। | প্রথমবারের বা লঘু অপরাধীকে সাজার কঠোরতা থেকে রক্ষা করে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া। | 
| কর্তৃপক্ষ | সাধারণত প্যারোল বোর্ড বা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এটি মঞ্জুর করে। | সরাসরি বিচারক বা আদালত রায় দেওয়ার সময় এটি মঞ্জুর করেন। | 
| মেয়াদ | প্যারোলের মেয়াদ হলো সাজার অবশিষ্ট সময়টুকু। | প্রবেশনের মেয়াদ আদালত কর্তৃক নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত বলবৎ থাকে। | 
৬. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কী? জনসংখ্যা কাঠামোর বৈশিষ্ট্য কী কী?
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ (Population Control)
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ হলো কোনো দেশ বা অঞ্চলের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে কাঙ্ক্ষিত বা স্থিতিশীল স্তরে রাখার জন্য সরকার বা সংশ্লিষ্ট সংস্থা কর্তৃক গৃহীত পরিকল্পিত এবং সমন্বিত পদক্ষেপসমূহ। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো জন্মহার হ্রাস করা এবং জনসংখ্যাকে দেশের সম্পদ, খাদ্য ও পরিবেশের ধারণক্ষমতার মধ্যে রাখা, যাতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হয়।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি:
- পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন।
- জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার বৃদ্ধি।
- নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন।
- বিবাহের বয়স বৃদ্ধি।
জনসংখ্যা কাঠামোর বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Population Structure)
জনসংখ্যা কাঠামো বলতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দেশের জনসংখ্যার বয়স, লিঙ্গ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা এবং ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে বিন্যাসকে বোঝায়। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
- বয়স কাঠামো (Age Structure): জনসংখ্যাকে প্রধানত তিনটি ভাগে (শিশু ও কিশোর – ০-১৪ বছর; কর্মক্ষম – ১৫-৬৪ বছর; বৃদ্ধ – ৬৫+ বছর) ভাগ করে এর অনুপাত নির্ণয় করা। এটি জনসংখ্যার পিরামিডের মাধ্যমে দেখানো হয়।
- লিঙ্গ অনুপাত (Sex Ratio): প্রতি ১০০০ পুরুষ বা নারীর বিপরীতে অপর লিঙ্গের সংখ্যা। এটি দেশের শ্রমবাজার, বিবাহ এবং সামাজিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে।
- নির্ভরশীলতার অনুপাত (Dependency Ratio): কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫-৬৪) দ্বারা নির্ভরশীল জনসংখ্যা (০-১৪ এবং ৬৫+) -কে ভাগ করে প্রাপ্ত অনুপাত। এই অনুপাত যত বেশি হয়, কর্মক্ষম জনগণের ওপর চাপ তত বাড়ে।
- গ্রামীণ ও শহুরে বিভাজন: জনসংখ্যার কত অংশ গ্রামে এবং কত অংশ শহরে বাস করে, তার বিন্যাস।
- শিক্ষা ও সাক্ষরতার হার: জনসংখ্যার মধ্যে সাক্ষরতার হার এবং বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা সমাপ্ত করা মানুষের সংখ্যা। এটি মানবসম্পদ উন্নয়নের নির্দেশক।
৭. শিক্ষানীতি কি? সামাজিক নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার ভূমিকা উল্লেখ কর। অথবা, শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা উল্লেখ কর।
শিক্ষানীতি (Education Policy)
শিক্ষানীতি হলো একটি দেশের সরকার কর্তৃক নির্ধারিত শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কাঠামো, শিক্ষাক্রম, অর্থায়ন ও বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনামূলক একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা। এটি দেশের আর্থ-সামাজিক চাহিদা ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে সঙ্গতি রেখে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিচালিত করে।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার ভূমিকা
সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হলো সেই প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সমাজ তার সদস্যদের আচরণকে নিয়ম, মূল্যবোধ ও প্রত্যাশা অনুযায়ী পরিচালিত করে। শিক্ষাব্যবস্থা এই নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে:
- নিয়ম-মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে আইন, নিয়ম, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পর্কে জ্ঞান দেয়, যা ছাত্রদের দায়িত্বশীল আচরণ গড়ে তোলে।
- আইন ও কাঠামোর জ্ঞান: শিক্ষা শিক্ষার্থীদের দেশের আইন, সংবিধান, সরকারি কাঠামো ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে, ফলে তারা সমাজের প্রচলিত নিয়ম মেনে চলতে অভ্যস্ত হয়।
- পেশাগত শৃঙ্খলা: শিক্ষা কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শৃঙ্খলামূলক আচরণ, সময়ানুবর্তিতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের অভ্যাস গড়ে তোলে।
- সামাজিক সংহতি: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন শ্রেণি, জাতি ও গোষ্ঠীর শিশুদের একত্রিত করে, যা তাদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতিবোধ সৃষ্টি করে এবং নিয়ন্ত্রণকে সহজ করে।
শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা
সামাজিকীকরণ হলো সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শিশু সমাজের নিয়ম, মূল্যবোধ ও আচরণবিধি শিখে সমাজের সদস্য হিসেবে গড়ে ওঠে। পরিবার হলো শিশুর সামাজিকীকরণের প্রধান এবং প্রথম মাধ্যম (Primary Agent)।
- প্রাথমিক ভিত্তি: পরিবারেই শিশু ভাষা, প্রাথমিক আবেগিক প্রতিক্রিয়া (স্নেহ, ভয়, রাগ) এবং সম্পর্কের প্রথম ধারণা পায়।
- মূল্যবোধ ও নৈতিকতা: বাবা-মা এবং পরিবারের সদস্যরা শিশুদের মধ্যে নৈতিক আদর্শ, ধর্মীয় বিশ্বাস, ভালো-মন্দের ধারণা ও সামাজিক মূল্যবোধের বীজ বপন করে।
- আচরণের প্রশিক্ষণ: শিশু পরিবারের কাছ থেকে আচার-ব্যবহার, খাদ্যভ্যাস, পরিচ্ছন্নতা, শৃঙ্খলা এবং সামাজিক শিষ্টাচারের প্রাথমিক পাঠ লাভ করে।
- লিঙ্গীয় ভূমিকা নির্ধারণ: পরিবারেই শিশু তার লিঙ্গীয় পরিচয় (Gender Role) অনুযায়ী সমাজে কী ধরনের আচরণ প্রত্যাশিত, সে সম্পর্কে সচেতন হয়।
- নিরাপত্তা ও আত্মবিশ্বাস: পরিবারের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও মানসিক দৃঢ়তা তৈরি করে, যা সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে।
৮. গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো কি? এর প্রকৃতি লিখ। অথবা, গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উতসগুলো কী?
গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো (Rural Power Structure)
গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো বলতে গ্রামীণ সমাজে প্রভাব, কর্তৃত্ব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কাদের হাতে কেন্দ্রীভূত, তার বিন্যাসকে বোঝায়। এটি হলো সেই পদ্ধতি, যার মাধ্যমে গ্রামীণ সমাজে প্রভাবশালী ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান তাদের সম্পদ, সামাজিক মর্যাদা, রাজনৈতিক সংযোগ বা বংশমর্যাদা ব্যবহার করে অন্যদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এই কাঠামো গ্রামের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে।
গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর প্রকৃতি
- ভূমিতে কেন্দ্রীভূত: গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর প্রধান ভিত্তি হলো জমির মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ। যাদের হাতে বেশি জমি, তারা সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তত বেশি প্রভাব রাখে।
- অসম ও স্তরভিত্তিক: ক্ষমতা সমাজের মুষ্টিমেয় ধনী কৃষক, জোতদার বা প্রভাবশালী বংশের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে, যা একটি অসম ও স্তরভিত্তিক ব্যবস্থা তৈরি করে।
- ব্যক্তিগত ও অপ্রাতিষ্ঠানিক: ক্ষমতা প্রায়শই আইনি বা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের চেয়ে ব্যক্তিগত প্রভাব, বংশমর্যাদা ও ঐতিহ্য দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রথাগত নেতা (মাতব্বর, মণ্ডল) অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।
- রাজনৈতিক সংযোগের প্রভাব: স্থানীয় নেতারা জাতীয় রাজনীতিকদের সাথে সংযোগ ব্যবহার করে গ্রামীণ ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে তোলেন।
- কর্তৃত্ববাদী: ক্ষমতা কাঠামোর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা (যেমন: ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, প্রভাবশালী মাতব্বর) প্রায়শই কর্তৃত্ববাদী মনোভাব নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যেখানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ কম থাকে।
গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উৎসসমূহ
- জমি বা ভূমি (Land): জমির মালিকানা হলো সবচেয়ে বড় উৎস। জমি অর্থনৈতিক প্রভাব, ঋণের সুযোগ এবং সামাজিক মর্যাদার জন্ম দেয়।
- সম্পদ ও অর্থনৈতিক প্রভাব (Wealth and Economic Power): নগদ অর্থ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে ঋণদানের (মহাজনী) ক্ষমতা ব্যক্তিকে প্রভাবশালী করে তোলে।
- বংশমর্যাদা ও ঐতিহ্য (Ancestry and Tradition): কোনো পরিবার যদি দীর্ঘদিন ধরে সমাজে উচ্চ অবস্থানে থাকে বা ঐতিহাসিকভাবে মাতব্বর হয়, তবে তা ক্ষমতার উৎসে পরিণত হয়।
- রাজনৈতিক ক্ষমতা (Political Power): স্থানীয় নেতৃত্ব (যেমন: ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বা সদস্য), রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্যপদ এবং উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক যোগাযোগ গ্রামীণ ক্ষমতাকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে।
- শিক্ষা ও পেশা (Education and Profession): উচ্চ শিক্ষিত এবং সরকারি বা অন্যান্য মর্যাদাপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা সমাজে অন্যদের চেয়ে বেশি সম্মান ও প্রভাব লাভ করে।
৯. সাংস্কৃতিক নির্ভরশীলতা বলতে কী বুঝ? অথবা, সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ বলতে কি বুঝ?
সাংস্কৃতিক নির্ভরশীলতা (Cultural Dependence)
সাংস্কৃতিক নির্ভরশীলতা হলো একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি দেশ বা সমাজ অন্য একটি প্রভাবশালী বা শক্তিশালী দেশের (সাধারণত পশ্চিমা উন্নত দেশ) সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, আদর্শ, জীবনধারা, পণ্য ও মিডিয়া ব্যবস্থার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং স্থানীয় সংস্কৃতিকে গৌণ করে ফেলে।
এর প্রভাব:
- স্থানীয় লোকশিল্প, প্রথা ও মূল্যবোধ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়।
- বিদেশী মিডিয়া, ফ্যাশন ও জীবনশৈলী সমাজের তরুণদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করে।
- এটি স্থানীয় সংস্কৃতিতে এক ধরনের হীনম্মন্যতা সৃষ্টি করতে পারে।
সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ (Cultural Pluralism)
সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ হলো এমন একটি সামাজিক অবস্থা, যেখানে একটি বৃহত্তর সমাজের অধীনে বিভিন্ন স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি (যেমন: ভাষা, ধর্ম, প্রথা, উৎসব) বজায় রেখেও শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে এবং বৃহত্তর সমাজের অংশ হিসেবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
মূল কথা: এখানে সমন্বয় বা মিশে যাওয়া নয়, বরং সহাবস্থান ও পারস্পরিক সম্মানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি সমাজে বৈচিত্র্যকে শক্তি ও সম্পদ হিসেবে দেখে এবং প্রতিটি সংস্কৃতিকে তার নিজস্বতা বজায় রাখার স্বাধীনতা দেয়।
১০. বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতি বলতে কী বুঝ?
সমাজবিজ্ঞানে সংস্কৃতিকে তার স্বরূপের ভিত্তিতে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়:
বস্তুগত সংস্কৃতি (Material Culture)
বস্তুগত সংস্কৃতি হলো মানব সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট সব ধরনের স্পর্শযোগ্য, দৈহিক বা ভৌত জিনিসপত্রের সমষ্টি। এই জিনিসপত্রগুলো মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করতে, চাহিদা মেটাতে এবং তাদের জীবনকে উন্নত করতে ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণ:
- যন্ত্রপাতি: কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, কৃষি সরঞ্জাম।
- স্থাপত্য: ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, বাঁধ, সেতু।
- পোশাক: বিভিন্ন ধরনের পরিধেয় বস্ত্র ও অলঙ্কার।
- শিল্পকলা: ভাস্কর্য, চিত্রকর্ম এবং মৃৎশিল্পের জিনিসপত্র।
অবস্তুগত সংস্কৃতি (Non-Material Culture)
অবস্তুগত সংস্কৃতি হলো মানব সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট সব ধরনের স্পর্শহীন, মানসিক বা ধারণাগত বিষয়গুলির সমষ্টি। এগুলি মানুষের আচরণ, চিন্তাভাবনা ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সমাজকে অর্থপূর্ণ করে তোলে।
উদাহরণ:
- জ্ঞান ও বিশ্বাস: ধর্মীয় বিশ্বাস, আদর্শ, বিজ্ঞান, প্রবাদ-প্রবচন।
- নিয়মকানুন: মূল্যবোধ, রীতিনীতি, আইন, প্রথা।
- যোগাযোগ: ভাষা, প্রতীক, সাংকেতিক চিহ্ন।
সম্পর্ক: বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতি একে অপরের ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল। যেমন, একটি মোবাইল ফোন (বস্তুগত) ব্যবহারের জন্য একটি ভাষার জ্ঞান (অবস্তুগত) প্রয়োজন। সংস্কৃতির এই দুটি দিক মিলেই একটি সমাজের পূর্ণাঙ্গ রূপ তৈরি হয়।
১১. সামাজিক অসমতা কি? এর প্রকৃতি ব্যাখ্যা কর। অথবা, সামাজিক অসমতার উপাদানগুলো কী?
সামাজিক অসমতা (Social Inequality)
সামাজিক অসমতা হলো সমাজের মানুষের মধ্যে সম্পদ, ক্ষমতা, সামাজিক মর্যাদা, সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার মান -এর ক্ষেত্রে একটি পদ্ধতিগত এবং কাঠামোগত বৈষম্যপূর্ণ বন্টন। এর অর্থ হলো, সমাজের কিছু মানুষ তাদের জন্ম, লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম বা শ্রেণির ওপর ভিত্তি করে অন্যদের তুলনায় বেশি সুবিধা ও সুযোগ ভোগ করে।
সামাজিক অসমতার প্রকৃতি
- কাঠামোগত (Structural): অসমতা কোনো ব্যক্তিগত ভুল বা আকস্মিক ঘটনা নয়, এটি সমাজের আইন, প্রতিষ্ঠান, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত থাকে।
- ব্যাপক এবং সর্বজনীন (Widespread and Universal): সামাজিক অসমতা পৃথিবীর সকল সমাজেই কোনো না কোনো রূপে বিদ্যমান।
- স্তরভিত্তিক (Stratified): এটি সমাজের সদস্যদের একটি উচ্চ-নিচ ভেদে ক্রমিক স্তরে (Hierarchy) বিন্যাস করে, যা সামাজিক স্তরবিন্যাস নামে পরিচিত।
- ঐতিহাসিক (Historical): অসমতা স্বল্পকালীন নয়, এটি দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, বিজয়, শোষণ এবং উত্তরাধিকারের মাধ্যমে গড়ে ওঠে।
- বহুমাত্রিক (Multidimensional): অসমতা শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি রাজনৈতিক ক্ষমতা, সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা ও সুযোগ-সুবিধাদির ভিত্তিতেও প্রকাশ পায়।
সামাজিক অসমতার উপাদানসমূহ
সামাজিক অসমতার প্রধান ভিত্তি বা উপাদানগুলো হলো:
- সম্পদ ও আয় (Wealth and Income): এটি প্রধানতম উপাদান। সম্পত্তি, বিনিয়োগ ও নগদ আয়ের অসম বন্টন সমাজে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য তৈরি করে।
- ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব (Power and Authority): সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ এবং অন্যের আচরণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার অসম বন্টন। রাজনৈতিক ক্ষমতা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
- সামাজিক মর্যাদা (Social Prestige): কোনো ব্যক্তির পেশা, বংশ বা ভূমিকার কারণে সমাজ তাকে যে সম্মান ও স্বীকৃতি দেয়, তার তারতম্য।
- শিক্ষা (Education): উচ্চমানের শিক্ষার সুযোগের অসমতা সমাজে ভালো চাকরি, উচ্চ আয় এবং উন্নত জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে অসমতা তৈরি করে।
- লিঙ্গ (Gender): নারী ও পুরুষের মধ্যে সামাজিক সুযোগ, মজুরি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কাঠামোগত বৈষম্য।
- জাতি/নৃগোষ্ঠী (Race/Ethnicity): জন্মগত জাতিগত পরিচয় বা নৃগোষ্ঠীর কারণে সুযোগ-সুবিধা লাভে বৈষম্য।
১২. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ কর।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (Permanent Settlement) হলো ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ গভর্নর-জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা। এটি গ্রামীণ বাংলার সামাজিক কাঠামোতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
- জমির মালিকানা জমিদারকে প্রদান: এই ব্যবস্থার মাধ্যমে জমিদারদেরকে জমির বংশানুক্রমিক মালিকানা প্রদান করা হয়। তারা কেবল রাজস্ব আদায়কারী না থেকে জমির প্রকৃত মালিক হয়ে ওঠেন।
- রাজস্বের চিরস্থায়ী নির্ধারণ: জমিদারদের জন্য সরকারকে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট, অপরিবর্তনীয় এবং চিরস্থায়ী রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। উৎপাদন বৃদ্ধি হলেও রাজস্বের পরিমাণ বাড়ত না।
- সূর্যাস্ত আইন (Sunset Law): এই কঠোর আইনের ফলে জমিদার যদি নির্দিষ্ট দিনের সূর্যাস্তের মধ্যে সরকারের কাছে নির্ধারিত রাজস্ব জমা দিতে ব্যর্থ হতেন, তবে তার জমির মালিকানা বাজেয়াপ্ত করে নতুন জমিদারের কাছে বিক্রি করা হতো।
- কৃষকের অধিকারহীনতা: কৃষকদের (রায়ত) জমির ওপর কোনো আইনি স্বত্ব বা অধিকার ছিল না। তারা কার্যত জমিদারদের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল প্রজা হয়ে ওঠেন।
- মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির সৃষ্টি: জমিদার ও কৃষকের মধ্যে তালুকদার, পত্তনিদার ইত্যাদি নামে বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির সৃষ্টি হয়, যা কৃষকদের ওপর শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে।
- গ্রামীণ সমাজের স্থিতিশীলতা নষ্ট: এই ব্যবস্থার ফলে গ্রামীণ সমাজে পুরোনো জমিদার পরিবারগুলো ধ্বংস হয় এবং নতুন ধনী শ্রেণির উত্থান ঘটে, যা সমাজের ক্ষমতা কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আনে।
১৩. ছয়দফা কর্মসূচি কি? এর কর্মসূচি উল্লেখ কর।
ছয়দফা কর্মসূচি (Six-Point Programme)
ছয়দফা কর্মসূচি হলো ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য নিরসনের জন্য উত্থাপিত একটি ঐতিহাসিক দাবি সনদ। এটি ছিল মূলত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে এটি ‘বাঙালির মুক্তির সনদ’ বা ‘ম্যাগনাকার্টা’ হিসেবে পরিচিত। এটিই ছিল স্বাধীনতার মূল ভিত্তি।
ছয়দফার কর্মসূচি (Programme)
ছয়দফার মূল কর্মসূচিগুলো হলো:
- শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি:
- পাকিস্তানে একটি ফেডারেল (যুক্তরাষ্ট্রীয়) পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
- সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের সার্বজনীন ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা থাকবে।
 
- কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা:
- কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা (Defence) ও বৈদেশিক নীতি (Foreign Affairs) থাকবে।
- অবশিষ্ট সব ক্ষমতা অঙ্গরাজ্যগুলোর (যেমন: পূর্ব পাকিস্তান) হাতে থাকবে।
 
- মুদ্রা ও আর্থিক ক্ষমতা:
- দুটি স্বতন্ত্র, সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে।
- বিকল্প হিসেবে, উভয় অঞ্চলের জন্য একটি অভিন্ন মুদ্রা থাকতে পারে, তবে পূর্ব পাকিস্তানের পুঁজি যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে, তার জন্য সাংবিধানিক সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকতে হবে।
 
- রাজস্ব, কর ও শুল্ক নির্ধারণ:
- রাজস্ব, কর ও শুল্ক নির্ধারণের ক্ষমতা অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে থাকবে।
- কেন্দ্রীয় সরকার অঙ্গরাজ্যের রাজস্বের একটি নির্দিষ্ট অংশ তার ব্যয় নির্বাহের জন্য পাবে।
 
- বৈদেশিক বাণিজ্য ও মুদ্রা তহবিল:
- বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষমতা অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে থাকবে।
- প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
 
- আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন:
পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এখানে আলাদা মিলিশিয়া বা আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করতে হবে।