ডিগ্রি সমাজবিজ্ঞান ৬ষ্ঠ পত্র গ-বিভাগ সাজেশন উত্তরসহ
ডিগ্রি সমাজবিজ্ঞান ৬ষ্ঠ পত্র গ-বিভাগ সাজেশন উত্তরসহ
৫। ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা কী? গ্রামীণ বাংলাদেশের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা আলোচনা কর।
ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা কী?
ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা (Land Tenure System) বলতে বোঝায় কোনো সমাজে মানুষ এবং জমির মধ্যে বিদ্যমান আইনি ও প্রথাগত সম্পর্ক। এটি নির্ধারণ করে কে, কখন, কীভাবে, কতটুকু সময়ের জন্য এবং কী কী শর্তে জমি ব্যবহার, নিয়ন্ত্রণ, হস্তান্তর বা তা থেকে প্রাপ্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবে।
মূলত, ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা হলো:
১. অধিকারের প্রকৃতি: জমি কার মালিকানায় থাকবে (রাষ্ট্র, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী)। ২. ব্যবহারের শর্তাবলী: জমি কীভাবে ব্যবহৃত হবে (কৃষি, শিল্প, বসতবাড়ি)। ৩. দায়িত্ব ও কর্তব্য: ভূমি ব্যবহারের বিপরীতে সরকারকে খাজনা বা শুল্ক পরিশোধের দায়িত্ব। ৪. হস্তান্তরের বিধান: জমি বিক্রি, ভাড়া, দান বা উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তরের নিয়মাবলী।
একটি দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো, কৃষি উৎপাদন এবং ক্ষমতা সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম।
গ্রামীণ বাংলাদেশের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার ঐতিহাসিক পটভূমি
বাংলাদেশের বর্তমান ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা একক কোনো ব্যবস্থার ফল নয়, বরং এটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক এবং পাকিস্তান আমলের দীর্ঘ ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফসল।
১. ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগ: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩)
ভূমিস্বত্বের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিল লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (Permanent Settlement)। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার জমিদারদের জমির স্থায়ী মালিকানা প্রদান করে এবং কৃষকদের পরিণত করে নিছক প্রজাতে।
- ফলাফল: এই ব্যবস্থা গ্রামে একটি শক্তিশালী জমিদার শ্রেণি তৈরি করে যারা খাজনা আদায় করত। অন্যদিকে, অসংখ্য কৃষক (রায়ত) তাদের জমির উপর অধিকার হারিয়ে শোষিত শ্রেণিতে পরিণত হয়। এটি জমির মালিকানা ও ক্ষমতাকে মুষ্টিমেয় হাতে কেন্দ্রীভূত করে এবং গ্রামীণ সমাজে চরম সামাজিক অসমতা সৃষ্টি করে।
২. পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশ: জমিদারী উচ্ছেদ
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ (East Bengal State Acquisition and Tenancy Act, 1950) পাসের মাধ্যমে জমিদারী প্রথার বিলুপ্তি ঘটানো হয়।
- উদ্দেশ্য: কৃষকদের সরাসরি সরকারের প্রজা বা রায়তে পরিণত করা এবং জমিদারদের দ্বারা সৃষ্ট শোষণ বন্ধ করা।
- ফলাফল: এই আইন গ্রামীণ সমাজে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও জমির মালিকানা পুরোপুরি কৃষকদের হাতে আসেনি। জোতদার নামে এক নতুন প্রভাবশালী শ্রেণি সৃষ্টি হয়, যারা প্রচুর জমির মালিক ছিল এবং এখনও গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে।
গ্রামীণ বাংলাদেশের বর্তমান ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার ধরন
বাংলাদেশের গ্রামীণ ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা বর্তমানে তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত, যা সমাজের ক্ষমতা ও মর্যাদাকে সরাসরি প্রভাবিত করে:
১. মালিকানাভিত্তিক স্বত্ব (Ownership Tenure)
এটি জমির উপর ব্যক্তির পূর্ণ অধিকার ও স্বত্বের ধারণা দেয়। এটি আবার দুই ধরনের হতে পারে:
- বৃহৎ জমির মালিক (জোতদার/ধনী কৃষক): এরা ঐতিহ্যগতভাবে সমাজে প্রভাবশালী। তাদের হাতে প্রচুর কৃষি জমি ও বসতভিটা কেন্দ্রীভূত, যা তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দেয়।
- স্বল্প বা ক্ষুদ্র জমির মালিক (স্বল্পবিত্ত কৃষক): এদের জমি সামান্য এবং প্রায়শই তা পারিবারিক চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট হয় না। তাই তাদের প্রায়শই অন্যের জমিতে শ্রম দিতে হয়।
- ভূমিহীন (Landless): যাদের কোনো কৃষি জমি বা বসতভিটাও নেই। এরা মূলত কৃষি শ্রমিক হিসেবে বা শহরে দিনমজুর হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করে। এই ভূমিহীন শ্রেণিই গ্রামীণ সমাজের সবচেয়ে দুর্বল অংশ।
২. ইজারাভিত্তিক স্বত্ব (Tenancy/Leasing Tenure)
জমির মালিকানা এক ব্যক্তির হাতে থাকলেও ব্যবহার ও চাষাবাদের অধিকার অন্যকে ইজারা দেওয়ার মাধ্যমে এই স্বত্ব সৃষ্টি হয়। গ্রামীণ বাংলাদেশে এটি সাধারণত তিন ধরনের:
- বর্গাচাষ (Sharecropping/Bargadar): এটি সবচেয়ে প্রচলিত প্রথা। এখানে বর্গাদার (ভূমিহীন বা ক্ষুদ্র কৃষক) জমির মালিকের সাথে উৎপাদনের একটি নির্দিষ্ট অংশ ভাগ করে নেয় (সাধারণত অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশ)। বর্গাদারেরা অনিশ্চিত জীবনযাপন করে, কারণ তাদের জমির উপর কোনো স্থায়ী অধিকার থাকে না।
- নির্দিষ্ট খাজনা বা পত্তনি স্বত্ব (Fixed Rent): কৃষক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জমিতে চাষ করার অধিকার পায় এবং ফসল হোক বা না হোক, মালিককে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বা ফসল প্রদান করে।
- শ্রমভিত্তিক স্বত্ব (Labour-Based Tenancy): এটি খুবই কম প্রচলিত। এখানে জমির মালিক কেবল চাষের জন্য শ্রমিককে পারিশ্রমিক দেন, কিন্তু জমির কোনো অংশ দেন না।
৩. সরকারি খাস জমি স্বত্ব (Government Khas Land)
রাষ্ট্রের মালিকানাধীন জমিকে খাস জমি বলা হয়। এই জমি প্রায়শই ভূমিহীন ও দরিদ্রদের মাঝে সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদী ইজারা বা সীমিত মালিকানা প্রদানের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। এই প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে গ্রামীণ সমাজে কিছুটা হলেও ভূমি বৈষম্য কমানোর চেষ্টা করা হয়, তবে রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির কারণে এর সঠিক বাস্তবায়ন প্রায়শই কঠিন হয়ে পড়ে।
ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার তাৎপর্য ও সমস্যা
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা সরাসরি সামাজিক স্তরবিন্যাস, ক্ষমতা সম্পর্ক ও কৃষি উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে।
- সামাজিক স্তরবিন্যাস: যার হাতে যত জমি, সমাজে তার মর্যাদা তত বেশি। ভূমির মালিকানা গ্রামীণ সমাজের জোতদার/মাতব্বর শ্রেণির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে, যা সামাজিক অসমতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
- কৃষি উৎপাদন: বর্গাচাষের মতো অনিশ্চিত স্বত্বের কারণে কৃষকেরা জমিতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ বা উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে উৎসাহিত হয় না, যা কৃষি উৎপাদনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করে।
- সমস্যা:
- খন্ড-বিখন্ড জমি: উত্তরাধিকার আইনের ফলে জমি ক্রমাগত ছোট ছোট খন্ডে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে, যা আধুনিক চাষাবাদের জন্য প্রতিকূল।
- ভূমি বিরোধ: জমির সঠিক রেকর্ড ও দুর্বল ভূমি ব্যবস্থাপনার কারণে অসংখ্য ভূমি বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে।
- ভূমির অপব্যবহার: কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে।
 
উপসংহার
বাংলাদেশের গ্রামীণ ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা একটি জটিল মিশ্র প্রক্রিয়া, যা ঐতিহাসিক শোষণ, আইনগত সংস্কার এবং বর্তমান অর্থনৈতিক চাহিদার ফসল। যদিও জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে, তবু জমির অসম বন্টন এবং ইজারাভিত্তিক চাষাবাদ আজও গ্রামীণ দারিদ্র্য ও সামাজিক অসমতার মূল কারণ হিসেবে বিদ্যমান। গ্রামীণ অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য একটি আধুনিক, স্বচ্ছ এবং দরিদ্র-বান্ধব ভূমি সংস্কার এবং ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।
৬। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যাসমূহ আলোচনা কর।
শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড এবং টেকসই উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি। বাংলাদেশ সরকার শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপ নিলেও, এই খাতটি বর্তমানে বেশ কিছু মৌলিক ও কাঠামোগত সমস্যায় জর্জরিত। এই সমস্যাগুলো গুণগত মান, প্রবেশগম্যতা এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, যা দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নকে ব্যাহত করছে।
১. শিক্ষার নিম্ন গুণগত মান (Low Quality of Education)
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো গুণগত মানের নিম্নমুখীতা। এর প্রধান কারণগুলো হলো:
- অদক্ষ ও অপ্রতুল শিক্ষক: প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, দক্ষতা এবং উচ্চমানের শিক্ষকের অভাব রয়েছে। অনেক শিক্ষকই আধুনিক শিক্ষণ পদ্ধতি (Teaching Methodology) সম্পর্কে অবগত নন।
- মানহীন পাঠ্যক্রম: পাঠ্যক্রম প্রায়শই মুখস্থনির্ভর এবং বাজারের চাহিদা বা বৈশ্বিক মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা (Critical Thinking) এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতার উপর কম জোর দেওয়া হয়।
- পরীক্ষা নির্ভরতা: পুরো শিক্ষাব্যবস্থা অতিরিক্ত পরীক্ষা ও ফলাফলের উপর নির্ভরশীল। এতে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের চেয়ে ভালো গ্রেড পাওয়ার দিকে বেশি মনোযোগ দেয়, যা শেখার প্রক্রিয়াকে নিরুৎসাহিত করে।
- ব্যবহারিক শিক্ষার অভাব: কারিগরি ও উচ্চশিক্ষায় ব্যবহারিক জ্ঞান, গবেষণা এবং শিল্প-সংস্থাগুলির (Industry) সাথে যোগাযোগের সুযোগ খুবই কম, ফলে ডিগ্রিধারীরা কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত থাকে না।
২. কাঠামোগত বৈষম্য ও বিভাজন
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত, যা সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করছে।
- শিক্ষার বহু ধারা: দেশে সাধারণ শিক্ষা (বাংলা মাধ্যম), ইংরেজি মাধ্যম (English Medium), মাদ্রাসা শিক্ষা (আলিয়া ও কওমি) এবং কারিগরি শিক্ষা—এই চারটি প্রধান ধারা বিদ্যমান। এই ধারাগুলোর মধ্যে পাঠ্যক্রম, শিক্ষার মান এবং সুযোগ-সুবিধার বিশাল পার্থক্য রয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক অসমতা তৈরি হয় এবং জাতীয় ঐক্য দুর্বল হয়।
- গ্রামীণ-শহুরে বৈষম্য: শহরাঞ্চলে উন্নত অবকাঠামো, মানসম্মত শিক্ষক এবং আধুনিক শিক্ষণ সামগ্রীর সুবিধা বেশি। অন্যদিকে, গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও মানসম্পন্ন শিক্ষক থেকে বঞ্চিত। ফলে গ্রাম ও শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুযোগের বিশাল ব্যবধান সৃষ্টি হয়।
- অর্থনৈতিক বৈষম্য: ধনী পরিবারের সন্তানরা ব্যয়বহুল বেসরকারি ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়, যেখানে নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরা মানহীন সরকারি বা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে বাধ্য হয়। শিক্ষা এক্ষেত্রে সামাজিক স্তরবিন্যাসের একটি বাহন হিসেবে কাজ করে।
৩. শিক্ষাব্যবস্থাপনা ও তদারকির সমস্যা
সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যাকে আরও জটিল করেছে।
- রাজনৈতিকীকরণ ও স্বজনপ্রীতি: শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অযোগ্য ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাওয়ায় শিক্ষার মান কমে যায়।
- অপর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ: জিডিপির তুলনায় শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় কম। এই অপর্যাপ্ত বরাদ্দ অবকাঠামো উন্নয়ন, গবেষণায় বিনিয়োগ এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে।
- দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা: শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি এবং অর্থ ও সম্পদের অপচয় একটি গুরুতর সমস্যা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে।
- শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া (Drop-out Rate): বিশেষ করে মাধ্যমিক ও নিম্ন-মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার এখনও অনেক বেশি। এর প্রধান কারণ হলো দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ (বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে) এবং কর্মসংস্থান খোঁজার তাগিদ।
৪. অবকাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত দুর্বলতা
- অপর্যাপ্ত অবকাঠামো: অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, বিজ্ঞানাগার, গ্রন্থাগার এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। দুর্বল ভৌত অবকাঠামো মানসম্মত শিক্ষাদানের পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
- প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার: শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় আধুনিক প্রযুক্তির (ICT) ব্যবহার এখনও সীমিত, বিশেষ করে গ্রামীণ স্কুলগুলোতে। অনেক শিক্ষকেরই প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা নেই, যা একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষার জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।
উপসংহার
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যাগুলো জটিল ও আন্তঃসংযুক্ত। গুণগত মান, বৈষম্য এবং ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা—এই তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা না করতে পারলে দেশের বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হবে। এই সমস্যাগুলোর সমাধানে প্রয়োজন জিডিপির আনুপাতিক হারে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, শিক্ষক প্রশিক্ষণের আধুনিকীকরণ, বহু ধারার শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন, এবং একটি স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষা প্রশাসন নিশ্চিত করা। একটি বৈষম্যহীন ও মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল বাংলাদেশ তার জনমিতিগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে একটি উন্নত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।
৭। শিল্পায়ন কী? বাংলাদেশে শিল্পায়নের প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর।
শিল্পায়ন কী?
শিল্পায়ন (Industrialization) হলো একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো দেশের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি কৃষি বা প্রাথমিক খাত থেকে ক্রমান্বয়ে শিল্প বা উৎপাদন খাতের দিকে স্থানান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি এবং আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়, ফলে বৃহৎ পরিসরে পণ্য ও সেবা উৎপাদন সম্ভব হয়।
শিল্পায়নের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
১. উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন: হস্তচালিত পদ্ধতির পরিবর্তে যন্ত্রনির্ভর ও স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয়। ২. অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন: জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান বৃদ্ধি পায় এবং কৃষি খাতের অবদান হ্রাস পায়। ৩. নগরায়ণ ও সামাজিক পরিবর্তন: কলকারখানার আশেপাশে নতুন শহর গড়ে ওঠে, জীবনযাত্রার মান পরিবর্তিত হয় এবং শ্রমজীবী শ্রেণির উত্থান ঘটে। ৪. মানবসম্পদের বিকাশ: নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের জন্য শ্রমিকদের দক্ষতা ও জ্ঞান বৃদ্ধি পায়।
শিল্পায়ন একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য অপরিহার্য।
বাংলাদেশে শিল্পায়নের প্রধান প্রতিবন্ধকতাসমূহ
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ শিল্পায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে (RMG), এই প্রক্রিয়াটি এখনও কিছু গভীর ও কাঠামোগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বাংলাদেশের শিল্পায়নের পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো নিচে বিশ্লেষণ করা হলো:
১. দুর্বল অবকাঠামো এবং জ্বালানি সংকট
বাংলাদেশের শিল্পায়নের পথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দুর্বল ও অপর্যাপ্ত ভৌত অবকাঠামো এবং জ্বালানি (Energy) সরবরাহ সংকট।
- বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট: শিল্প উৎপাদনের জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে গ্যাসের অপ্রতুলতা এবং বিদ্যুতের লোডশেডিং বা ঘন ঘন বিভ্রাট উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে তোলে এবং কারখানার পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহারে বাধা দেয়।
- যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা: সড়ক, রেল ও নদীপথের দুর্বলতা এবং বিশেষত চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের ধারণক্ষমতার অভাব পণ্য আমদানি-রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ পরিবহণে বিলম্ব ঘটায়। এতে শিল্প উদ্যোক্তাদের সময় ও অর্থ উভয়ই নষ্ট হয়।
- অপর্যাপ্ত শিল্পাঞ্চল: আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন পরিকল্পিত শিল্প পার্ক বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (SEZ) অভাব রয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে কারখানা স্থাপন পরিবেশ দূষণ এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনার জন্ম দেয়।
২. মূলধন ও অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা
- উচ্চ সুদের হার: ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে উচ্চ সুদের হার অনেক উদ্যোক্তাকে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (SME) খাতকে, বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করে।
- দীর্ঘমেয়াদী মূলধনের অভাব: শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় দীর্ঘমেয়াদী মূলধন বা প্রজেক্ট ফাইন্যান্সিং-এর অভাব রয়েছে। মূলধন বাজার (Stock Market) এখনও শিল্পের বড় বিনিয়োগের জন্য নির্ভরযোগ্য উৎস হতে পারেনি।
- আমলাতান্ত্রিক জটিলতা: ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ এবং বিনিয়োগের অন্যান্য প্রক্রিয়া অত্যন্ত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং দীর্ঘসূত্রিতার জালে আবদ্ধ।
৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতা
- রাজনৈতিক অস্থিরতা: ঘন ঘন রাজনৈতিক ধর্মঘট, অবরোধ বা হরতালের মতো কর্মসূচি শিল্প উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খলকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে।
- দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা: প্রশাসন ও সরকারি দপ্তরে ব্যাপক দুর্নীতি শিল্প স্থাপনের প্রক্রিয়াকে জটিল ও ব্যয়বহুল করে তোলে। ঘুষ ছাড়া অনেক সময়ই লাইসেন্স বা অনুমোদন পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।
- দুর্বল আইনের শাসন: চুক্তি কার্যকর করার প্রক্রিয়া এবং ব্যবসায়িক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি দক্ষ বিচারিক ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। এটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে বড় বাধা।
৪. মানবসম্পদ ও প্রযুক্তির ঘাটতি
- দক্ষ শ্রমিকের অভাব: দেশের জনসংখ্যা বেশি হলেও শিল্প কারখানা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিকের অভাব রয়েছে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার দুর্বলতা এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
- গবেষণা ও উন্নয়নের অভাব: শিল্প খাতে গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) বিনিয়োগ খুবই নগণ্য। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে, ফলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়।
- উদ্যোক্তা উন্নয়ন: তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, মেন্টরশিপ ও ইনকিউবেশন সুবিধার অভাব রয়েছে।
৫. অভ্যন্তরীণ বাজারের সীমাবদ্ধতা ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা
- সীমিত অভ্যন্তরীণ বাজার: জনগণের ক্রয়ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারের আকার প্রত্যাশিতভাবে বড় নয়, যা বৃহৎ আকারের উৎপাদনকে সীমিত করে।
- বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা: বাংলাদেশের শিল্প পণ্যগুলোকে বিশ্ববাজারে চীন, ভিয়েতনাম বা ভারতের মতো প্রতিযোগীদের সাথে লড়াই করতে হয়। অবকাঠামোগত খরচ ও প্রযুক্তিগত দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশের পণ্যের উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে যায়।
উপসংহার
শিল্পায়ন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রধান সোপান হলেও, এই প্রক্রিয়াটি দুর্বল অবকাঠামো, দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানি সংকট, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থায়নের জটিলতা এবং দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত শিল্পায়ন নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে একটি ব্যাপকভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে, যেখানে অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতে অগ্রাধিকার বিনিয়োগ, ‘এক-দরজা সেবা’ (One-Stop Service) নিশ্চিত করে প্রশাসনিক জটিলতা দূরীকরণ, এবং কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির উপর জোর দিতে হবে। এই প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে পারলেই বাংলাদেশ একটি শিল্পোন্নত জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
৮। বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের কারণসমূহ আলোচনা কর।
কিশোর অপরাধ (Juvenile Delinquency) হলো ১৮ বছরের কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের দ্বারা সংঘটিত সেসব সমাজবিরোধী বা আইন ভঙ্গকারী কাজ, যা একজন প্রাপ্তবয়স্কের দ্বারা সংঘটিত হলে তাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো। বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ একটি ক্রমবর্ধমান সামাজিক সমস্যা, যা কেবল আইন-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রেই নয়, বরং সমাজের ভবিষ্যৎ গঠনেও বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। এই অপরাধের পেছনে একক কোনো কারণ দায়ী নয়, বরং জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক, পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলোর এক জটিল মিথস্ক্রিয়া কাজ করে।
১. পারিবারিক কারণসমূহ
পরিবার হলো সামাজিকীকরণের প্রথম ও প্রধান ভিত্তি। পারিবারিক কাঠামোর দুর্বলতা কিশোর অপরাধের মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।
- বিচ্ছিন্ন বা ভাঙা পরিবার (Broken Homes): পিতামাতার বিচ্ছেদ, বিবাহবিচ্ছেদ বা দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি শিশুদের মধ্যে মানসিক নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে। স্নেহ ও তদারকির অভাবে কিশোররা সহজেই ভুল পথে চালিত হয়।
- পারিবারিক কলহ ও মানসিক চাপ: পরিবারে ঘন ঘন ঝগড়া, সহিংসতা বা পিতামাতার অসামাজিক আচরণ কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আগ্রাসী মনোভাব জন্ম দেয়। তারা এই আচরণগুলো অনুকরণ করে এবং সমাজে তার প্রতিফলন ঘটায়।
- অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ বা অতি-শিথিলতা: একদিকে যেমন অতিরিক্ত কঠোর শাসন ও নিয়ন্ত্রণ কিশোরদের বিদ্রোহী করে তোলে, তেমনি অন্যদিকে অতিরিক্ত স্বাধীনতা ও তদারকির অভাবও তাদের বিপথগামী হতে সাহায্য করে।
- দারিদ্র্য: দরিদ্র পরিবারে সন্তানদের মৌলিক চাহিদা (খাদ্য, শিক্ষা, বস্ত্র) মেটানো সম্ভব হয় না। এই অভাব মেটানোর জন্য অনেক কিশোর চুরি, ছিনতাই বা ছোটখাটো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
২. সামাজিক ও পরিবেশগত কারণসমূহ
সমাজের চারপাশের পরিবেশ এবং দুর্বল সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো কিশোর অপরাধকে উসকে দেয়।
- খারাপ সঙ্গ বা গ্যাং সংস্কৃতি (Gang Culture): কিশোররা প্রায়শই সমবয়সী বা ‘পিয়ার গ্রুপ’-এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। দুর্বল বা অপরাধপ্রবণ বন্ধুর সঙ্গে মিশে তারা ছোটখাটো অপরাধ (যেমন— মাদক সেবন, ইভটিজিং, মারামারি) থেকে শুরু করে বড় ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে কিশোর গ্যাং-এর বিস্তার বর্তমানে একটি বড় উদ্বেগের কারণ।
- নগরায়ণ ও বস্তি জীবন: দ্রুত নগরায়ণ এবং বস্তি এলাকায় অপরিকল্পিত জীবনযাত্রা সামাজিক শৃঙ্খলার অভাব তৈরি করে। ঘনবসতিপূর্ণ বস্তিগুলোতে খেলাধুলা, শিক্ষা ও বিনোদনের সুযোগের অভাবে কিশোররা অলসতা থেকে অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা: মানসম্মত শিক্ষার অভাব, পরীক্ষায় ব্যর্থতা বা স্কুল থেকে ঝরে পড়া (Drop-out) কিশোরদের হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। ঝরে পড়া শিশুরা কোনো কাজে যুক্ত না হতে পেরে অপরাধপ্রবণদের সংস্পর্শে আসে।
৩. অর্থনৈতিক কারণসমূহ
অর্থনৈতিক বৈষম্য ও নিরাপত্তাহীনতা কিশোর অপরাধকে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।
- বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের অভাব: পড়াশোনা শেষে বা মাঝপথে ঝরে পড়ার পর যখন কিশোররা কোনো সম্মানজনক কাজ খুঁজে পায় না, তখন হতাশা থেকে সহজে অর্থ উপার্জনের জন্য তারা অপরাধের দিকে ধাবিত হয়।
- অর্থনৈতিক বৈষম্য: সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে প্রকট বৈষম্য দরিদ্র কিশোরদের মধ্যে বঞ্চনা ও ঈর্ষার জন্ম দেয়। ধনী বা ক্ষমতাশীলদের জীবনযাত্রা দেখে তারা হতাশ হয় এবং দ্রুত ধনী হওয়ার আশায় অপরাধমূলক পথ বেছে নেয়।
- শিশুশ্রম: অনেক দরিদ্র কিশোরকে বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও কম পারিশ্রমিকের কাজে নিয়োজিত হতে হয়। এতে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং তারা সহজে সমাজবিরোধী কাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়।
৪. মনস্তাত্ত্বিক ও মানসিক কারণসমূহ
ব্যক্তিগত মানসিক দুর্বলতা এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের অভাবও অপরাধের জন্ম দেয়।
- মানসিক সমস্যা: অনেক কিশোর-কিশোরীর মধ্যে মনোযোগের অভাব (ADHD), হতাশা বা বিষণ্নতার মতো মানসিক সমস্যা থাকতে পারে, যা তাদের আচরণকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
- অপরিণত বিচারবোধ: কৈশোর একটি অস্থায়ী সময়, যখন কিশোর-কিশোরীদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকে এবং ভালো-মন্দের বিচারবোধ পুরোপুরি গড়ে ওঠে না। এই সময়ে তারা তাৎক্ষণিক উত্তেজনা বা অ্যাডভেঞ্চারের লোভে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়।
৫. গণমাধ্যম ও প্রযুক্তির প্রভাব
- নেতিবাচক গণমাধ্যম প্রভাব: চলচ্চিত্র, টেলিভিশন অনুষ্ঠান এবং ইন্টারনেটে প্রচারিত সহিংসতা ও অপরাধমূলক দৃশ্যাবলী দেখে কিশোররা সেগুলোকে বাস্তব জীবনে অনুকরণ করার চেষ্টা করে।
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সাইবার অপরাধ: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেকে জাহির করার প্রবণতা, সাইবার বুলিং, এবং অনলাইন গেমসের আসক্তি কিশোরদের মধ্যে অস্থিরতা ও агреসিভ মনোভাব সৃষ্টি করে।
উপসংহার
বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ একটি জটিল এবং বহুমুখী সমস্যা, যার মূল কারণগুলো পরিবার, সমাজ, অর্থনীতি ও ব্যক্তিগত মনস্তত্ত্বের গভীরে প্রোথিত। এই সমস্যা মোকাবিলায় শুধু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন একটি সমন্বিত উদ্যোগ, যেখানে পিতামাতা-শিক্ষক-সমাজ-সরকার একযোগে কাজ করবে। পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করা, শিক্ষাব্যবস্থাকে জীবনমুখী ও কর্মসংস্থান-ভিত্তিক করা, অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করা এবং কিশোরদের জন্য পর্যাপ্ত বিনোদন ও খেলাধুলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা—এগুলোই হলো কিশোর অপরাধ প্রতিরোধের কার্যকর উপায়। কিশোরদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে পারলেই কেবল একটি সুস্থ ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ সমাজ নিশ্চিত করা সম্ভব।
৯। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সামাজিক ও ঐতিহাসিক পটভূমি।আলোচনা কর।
বাংলাদেশের অভ্যুদয় একদিনের কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ সংগ্রামের ফল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির বীজ বপন হয়েছিল, আর ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সেই বীজ মহীরুহে পরিণত হয়। বাংলাদেশের জন্মলগ্নকে বোঝার জন্য এর সামাজিক ও ঐতিহাসিক পটভূমি বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য।
১. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: দ্বি-জাতি তত্ত্বের দুর্বলতা
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঐতিহাসিক পটভূমি শুরু হয় ১৯৪৭ সালে।
- দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি: ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের সময় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়। এই তত্ত্ব অনুসারে, ধর্মীয় পরিচয়ের (হিন্দু ও মুসলিম) ভিত্তিতে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান গঠিত হয়। বাঙালি মুসলমানরা ধর্মীয় পরিচিতির কারণে পাকিস্তানের অংশ হয়, কিন্তু দুই অঞ্চলের মধ্যে ছিল বিশাল ভৌগোলিক দূরত্ব।
- ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বৈসাদৃশ্য: পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ধর্ম ছাড়া আর কোনো বিষয়েই মিল ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ভাষা ছিল বাংলা, সংস্কৃতি ছিল কৃষিভিত্তিক ও লোকায়ত, আর পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান ভাষা ছিল উর্দু এবং সংস্কৃতি ছিল প্রধানত সেমি-ফিউডাল। এই বৈসাদৃশ্যই দ্রুত জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে ধর্মকে দুর্বল করে দেয়।
- ক্ষমতার কেন্দ্র পশ্চিম পাকিস্তানে: শুরু থেকেই রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, যার ফলস্বরূপ পূর্ব পাকিস্তানকে একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত করা হয়।
২. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য এবং প্রতিরোধ
রাজনৈতিক শোষণ শুরুর আগেই সাংস্কৃতিক নিপীড়ন শুরু হয়, যা বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়।
- ভাষা আন্দোলন (১৯৫২): পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র করে, তখন বাঙালিরা ফুঁসে ওঠে। ২১শে ফেব্রুয়ারি রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি বুঝতে পারে যে, ধর্মের চেয়ে ভাষা ও সংস্কৃতিই তাদের আসল পরিচয়। এই আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের প্রথম ও প্রধান ধাপ।
- সাংস্কৃতিক শোষণ: ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করা, বাংলা নববর্ষের উৎসব বন্ধ করার চেষ্টা এবং ইসলামীকরণ চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
- গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ: ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হয়। বাঙালিরা উপলব্ধি করে যে, নির্বাচনের মাধ্যমেও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, যা সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি করে।
৩. অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনা
দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করা হয়।
- সম্পদের বন্টনে বৈষম্য: পূর্ব পাকিস্তানের পাট, চা ও অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ ব্যয় করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পায়ন ও সামরিক খাতে। পূর্ব পাকিস্তান কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের বাজারের কাঁচামালের সরবরাহকারী এবং উৎপাদিত পণ্যের ভোক্তা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
- সরকারি চাকরিতে বৈষম্য: সামরিক বাহিনী, উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরি এবং প্রশাসনিক পদগুলোতে বাঙালিদের উপস্থিতি ছিল ন্যূনতম। এই বৈষম্য কেবল অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব সৃষ্টি করেনি, বরং বাঙালিদের মধ্যে বঞ্চনার তীব্র অনুভূতি তৈরি করেছিল।
- উন্নয়নমূলক কাজে বৈষম্য: যোগাযোগ, শিল্প, বিদ্যুৎ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে কয়েক গুণ বেশি অর্থ বরাদ্দ করা হতো। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে এই বৈষম্য এতটাই প্রকট ছিল যে, পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জীবনযাত্রার মান আকাশ-পাতাল হয়ে যায়।
৪. স্বাধীনতার চূড়ান্ত পথরেখা
ষাট দশকে সৃষ্ট আন্দোলনগুলো চূড়ান্ত স্বাধীনতার পটভূমি রচনা করে।
- ছয় দফা আন্দোলন (১৯৬৬): শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত ছয় দফা ছিল কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি। এটি ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে পরিচিত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত রূপ।
- ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯): ছয় দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট গণঅসন্তোষ তীব্র গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়, যা আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের পতন ঘটায়। এই অভ্যুত্থান বাঙালি জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা ও ঐক্যকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়।
- ৭০-এর নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি: ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, যা প্রমাণ করে যে বাঙালিরা ছয় দফার পক্ষে ম্যান্ডেট দিয়েছে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়।
- সশস্ত্র সংগ্রাম ও স্বাধীনতা: ক্ষমতা হস্তান্তরের বদলে ২৫শে মার্চ ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে গণহত্যা শুরু করে। এই পটভূমিতেই ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাঙালি জাতি নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
উপসংহার
বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল মূলত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ব্যর্থতা, সাংস্কৃতিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক শোষণ এবং গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি অনিবার্য পরিণতি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই এই ঐতিহাসিক ও সামাজিক পটভূমি স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে চলার শক্তি জুগিয়েছে। এই সংগ্রাম প্রমাণ করে যে, ভাষা, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের দাবি যেকোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে শক্তিশালী হতে পারে।
১০। বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়নে সুশীল সমাজের ভূমিকা মূল্যায়ন কর।
সুশীল সমাজ (Civil Society) বলতে সাধারণত সেই সমস্ত অ-সরকারি, অ-রাজনৈতিক ও অ-বাণিজ্যিক সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এবং উদ্যোগগুলোকে বোঝায়, যারা সমাজ এবং রাষ্ট্রের মধ্যবর্তী স্থানে থেকে জনগণের স্বার্থ রক্ষা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী সংগঠন, মানবাধিকার সংস্থা, গণমাধ্যম, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (NGOs) এবং বিভিন্ন নাগরিক ফোরাম। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সুশীল সমাজ গণতন্ত্রায়নকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সুশীল সমাজের ধারণা ও গুরুত্ব
সুশীল সমাজ মূলত জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সরকারের কর্মকাণ্ডের উপর একটি গঠনমূলক নজরদারি তৈরি করে। গণতন্ত্রায়নের প্রক্রিয়ায় এর গুরুত্ব হলো:
- জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা: সুশীল সমাজ সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করে।
- স্বচ্ছতা বৃদ্ধি: রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে তারা তথ্য ও উপাত্ত প্রকাশ করে।
- নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টি: তারা জনগণকে তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
- ক্ষমতা হ্রাসের প্রতিরোধক: এটি রাষ্ট্রের একচেটিয়া ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে সহায়ক হয়।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়নে সুশীল সমাজের ইতিবাচক ভূমিকা
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পথ কখনোই মসৃণ ছিল না। সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই থেকে শুরু করে বর্তমান গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সুশীল সমাজ বহুলাংশে সফলতার পরিচয় দিয়েছে।
১. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা ও সামরিক শাসন প্রতিরোধ:
১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে সুশীল সমাজের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীরা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনগণের পক্ষে রাজপথে নেমে এসেছিলেন। তাদের এই আন্দোলন জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং স্বৈরাচারমুক্ত রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা তীব্র করেছিল।
২. নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও আস্থা তৈরি:
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ এবং নির্বাচন কমিশনকে সংস্কারের চাপ দেওয়ার মাধ্যমে সুশীল সমাজ একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সময়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অনুরূপ প্রক্রিয়ার দাবি উত্থাপনে সুশীল সমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
৩. মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা:
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, যেমন— আইন ও সালিশ কেন্দ্র (ASK), অধিকার, নির্যাতিত ও প্রান্তিক মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করে। তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হেফাজতে মৃত্যু এবং রাজনৈতিক নিপীড়নের ঘটনাগুলো জনসমক্ষে আনে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের আইনি সহায়তা দেয়। এর ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ন্ত্রণে আসে।
৪. নীতি প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার:
অনেক সুশীল সমাজ সংগঠন নীতি প্রণয়নের সময় সরকারকে কারিগরি ও গবেষণাভিত্তিক সহায়তা প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, নারী উন্নয়ন নীতি, বা তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নে সুশীল সমাজের বিশেষজ্ঞ মতামত সরকারকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়েছে।
৫. দারিদ্র্য বিমোচন ও তৃণমূলের ক্ষমতায়ন (NGOs-এর মাধ্যমে):
বাংলাদেশে এনজিও (NGO) গুলো সুশীল সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ব্র্যাক (BRAC), গ্রামীণ ব্যাংক (যদিও এটি কিছুটা ভিন্ন), আশা-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্র ঋণ, স্বাস্থ্যসেবা, এবং শিক্ষার মাধ্যমে গ্রামীণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটিয়েছে, যা কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য একটি শক্তিশালী সামাজিক ভিত্তি তৈরি করে।
সুশীল সমাজের চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা
সুশীল সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও, বাংলাদেশে এর কার্যকারিতা বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
১. সরকারের চাপ ও সীমিত পরিসর:
অনেক সময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো সুশীল সমাজের সমালোচনাকে ভালো চোখে দেখে না। ফলে বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে তাদের তহবিল নিয়ন্ত্রণ বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর কার্যক্রম সীমিত করার চেষ্টা করা হয়। এতে সুশীল সমাজের কার্যকারিতা কমে যায়।
২. রাজনৈতিক মেরুকরণ:
বাংলাদেশের সুশীল সমাজও প্রায়শই রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত ও মেরুকৃত। কিছু সংগঠন প্রকাশ্যে বা গোপনে সরকার বা বিরোধী দলের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগের সম্মুখীন হয়। এই মেরুকরণ তাদের নিরপেক্ষতা এবং সামগ্রিক গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
৩. শহরকেন্দ্রিকতা ও সীমিত জনসম্পৃক্ততা:
সুশীল সমাজের অধিকাংশ কার্যক্রম ও নেতৃত্ব ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরকেন্দ্রিক। তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের সাথে তাদের সংযোগ ও সম্পৃক্ততা এখনও দুর্বল, যার ফলে তাদের বার্তা সমাজের সকল স্তরে সমানভাবে পৌঁছায় না।
৪. অর্থায়নের উপর নির্ভরতা:
অনেক বড় এনজিও এবং থিংক ট্যাঙ্ক তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিদেশি অনুদানের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল, যা তাদের সমালোচনার মুখে পড়তে বাধ্য করে এবং তাদের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
উপসংহার
বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়নে সুশীল সমাজ নিঃসন্দেহে একটি অপরিহার্য শক্তি। তারা সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, মানবাধিকার রক্ষা, এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। তবে, এই ভূমিকাকে আরও কার্যকর করতে হলে সুশীল সমাজকে অবশ্যই রাজনৈতিক মেরুকরণ থেকে মুক্ত থাকতে হবে, তৃণমূল পর্যায়ে তাদের কার্যক্রমের বিস্তার ঘটাতে হবে, এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মানদণ্ড বজায় রাখতে হবে। সরকারের উচিত সুশীল সমাজকে প্রতিপক্ষ না ভেবে গণতন্ত্রের সহযোগী শক্তি হিসেবে গণ্য করা এবং তাদের জন্য স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করা। সামগ্রিকভাবে, একটি শক্তিশালী সুশীল সমাজের উপস্থিতিই বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরও মজবুত, স্থিতিশীল ও জনমুখী করে তুলতে পারে।
১১। নারী শিক্ষার উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ আলোচনা কর।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নারী শিক্ষা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগগুলির মধ্যে অন্যতম। লিঙ্গ সমতা অর্জন, দারিদ্র্য বিমোচন, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা অপরিহার্য। স্বাধীনতার পর থেকেই বিভিন্ন সরকার নারী শিক্ষার প্রসারে গুরুত্ব দিয়ে আসছে, তবে গত কয়েক দশকে গৃহীত হয়েছে ব্যাপকভিত্তিক ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপগুলি মূলত ভর্তির হার বৃদ্ধি, ঝরে পড়া রোধ এবং গুণগত মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরিচালিত।
১. আর্থিক সহায়তা ও প্রণোদনামূলক কর্মসূচি
নারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় ধরে রাখতে এবং অভিভাবকদের আর্থিক চাপ কমাতে সরকার বহু যুগান্তকারী আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি চালু করেছে।
ক. উপবৃত্তি ও বেতন মওকুফ:
- মাধ্যমিক স্তরের উপবৃত্তি: নারী শিক্ষা প্রসারে সবচেয়ে সফল পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৯৪ সালে প্রবর্তিত মাধ্যমিক স্তরের উপবৃত্তি কর্মসূচি। এই কর্মসূচির অধীনে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত গ্রামীণ এলাকার মেয়ে শিক্ষার্থীদের (নির্দিষ্ট সংখ্যক নম্বর পাওয়ার শর্তে) মাসিক উপবৃত্তি প্রদান করা হয়।
- বেতন মওকুফ: মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের জন্য বেতন মওকুফ করা হয়েছে। এটি অভিভাবক ও ছাত্রীদের শিক্ষায় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করেছে। এর ফলে মাধ্যমিক শিক্ষায় ছেলে ও মেয়েদের ভর্তির হারে প্রায় সমতা এসেছে।
- শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট: সরকার ‘প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট’ গঠন করেছে, যার মাধ্যমে দুস্থ ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নারী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।
খ. প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ:
- বর্তমানে স্নাতক (ডিগ্রি) পর্যায়েও মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি চালু রয়েছে, যা উচ্চশিক্ষার পথকে আরও সহজ করেছে।
২. প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার
নারী শিক্ষার প্রবেশগম্যতা বাড়াতে সরকার শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত পরিবর্তন এনেছে।
- শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি: মেয়েদের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (যেমন— মহিলা কলেজ) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং বিদ্যমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আসন সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
- শিক্ষানীতি ও কৌশলগত পরিকল্পনা: জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ নারী শিক্ষার উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই নীতিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
- অবকাঠামোগত উন্নয়ন: বিদ্যালয়গুলোতে মেয়েদের জন্য আলাদা স্যানিটেশন ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে।
৩. বাধ্যতামূলক শিক্ষা ও বিনামূল্যে বই বিতরণ
শিক্ষার মূল ভিত্তি মজবুত করার জন্য সরকার প্রাথমিক শিক্ষায় আইনি বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে।
- প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলককরণ: মেয়ে-ছেলে নির্বিশেষে সকলের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা (পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত) বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করা হয়েছে। এর ফলে মেয়েদের বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বহুলাংশে বেড়েছে।
- বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ: প্রতি বছর প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হয়। এই পদক্ষেপটি দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকদের উপর থেকে বই কেনার আর্থিক বোঝা কমিয়েছে, যা মেয়েদের স্কুলে ভর্তির জন্য একটি বড় উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছে।
৪. সচেতনতা সৃষ্টি ও সামাজিক নিরাপত্তা
শিক্ষা গ্রহণে বাধা সৃষ্টিকারী সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সরকার বিভিন্ন সামাজিক পদক্ষেপ নিয়েছে।
- বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ: নারী শিক্ষার প্রসারে বাল্যবিবাহ একটি বড় বাধা। সরকার বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন কঠোর করেছে এবং এই প্রথা রোধে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, যাতে মেয়েরা শিক্ষা শেষ করার সুযোগ পায়।
- মাতৃত্বকালীন ছুটি: কর্মজীবী মায়েদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধির মাধ্যমে মায়েদের কাজে ফেরার সুযোগ বাড়ানো হয়েছে, যা পরোক্ষভাবে মেয়েদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক উদাহরণ তৈরি করে।
- নারীর ক্ষমতায়ন: স্থানীয় সরকারে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সমাজে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা নারী শিক্ষাকে আরও উৎসাহিত করছে।
৫. কারিগরি ও উচ্চশিক্ষায় বিশেষ মনোযোগ
শুধু সাধারণ শিক্ষায় নয়, উচ্চশিক্ষা ও কারিগরি ক্ষেত্রেও মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
- কারিগরি শিক্ষায় বিশেষ সুবিধা: কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় মেয়েদের ভর্তির জন্য বিশেষ কোটা ও আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।
- নারী শিক্ষক নিয়োগ: প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নারী শিক্ষকের হার বাড়ানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নারী শিক্ষকের উপস্থিতি মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।
উপসংহার
নারী শিক্ষার উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার গত কয়েক দশকে গৃহীত বিভিন্ন আর্থিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক পদক্ষেপের কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের ভর্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করেছে এবং জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। তবে এখনও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, ঝরে পড়ার হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা এবং উচ্চশিক্ষা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর মতো বড় চ্যালেঞ্জগুলো বিদ্যমান। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় আরও সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারলে নারী শিক্ষাই হবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীল সমাজ গঠনের মূল ভিত্তি।
১২। বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তনশীল ধারা আলোচনা কর।
বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি হাজার বছরের ঐতিহ্য, ঔপনিবেশিক প্রভাব এবং আধুনিকায়নের এক জটিল মিথস্ক্রিয়ার ফল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এবং বিশেষ করে গত কয়েক দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নগরায়ণ, প্রযুক্তির প্রসার এবং বিশ্বায়নের প্রভাবে এই সমাজ ও সংস্কৃতিতে এসেছে ব্যাপক ও দ্রুত পরিবর্তন। এই পরিবর্তনশীল ধারা সমাজের প্রায় সকল স্তরে—পারিবারিক কাঠামো থেকে শুরু করে ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক এবং মূল্যবোধ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
১. পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন
ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের সমাজ ছিল কৃষিভিত্তিক, গ্রামীণ এবং যৌথ পরিবারকেন্দ্রিক। কিন্তু আধুনিকায়নের ফলে এই কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে।
- যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবার: গ্রামীণ অর্থনীতি দুর্বল হওয়া এবং শহরমুখী কর্মসংস্থানের সন্ধানে মানুষের অভিপ্রায়ণের (Migration) ফলে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারের (Nuclear Family) সংখ্যা বাড়ছে। এতে পারিবারিক বন্ধন কিছুটা শিথিল হলেও, ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়ছে।
- নারীর ক্ষমতায়ন ও ভূমিকা পরিবর্তন: শিক্ষা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সমাজে তাদের ভূমিকা পরিবর্তিত হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পে বা সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নারীদের উপস্থিতি এখন একটি স্বাভাবিক চিত্র। এর ফলে পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর প্রভাব বাড়ছে এবং লিঙ্গভিত্তিক গতানুগতিক ভূমিকাগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
- বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা: অর্থনৈতিক চাপ এবং একক পরিবারের প্রবণতার কারণে বয়স্ক বাবা-মাকে সন্তানেরা সেবার বদলে অনেক ক্ষেত্রেই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে। এটি একসময়কার ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক সংহতির বিপরীতে একটি নতুন ও উদ্বেগজনক সামাজিক বাস্তবতা।
২. নগরায়ণ ও গ্রামীণ-শহুরে সংস্কৃতির মিশ্রণ
দ্রুত নগরায়ণ সমাজ ও সংস্কৃতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তন এনেছে।
- শহরকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা: মানুষ গ্রাম ছেড়ে কাজের সন্ধানে শহরে আসায় ঢাকা, চট্টগ্রাম বা অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলো দ্রুত বেড়ে উঠছে। শহুরে জীবনযাত্রার দ্রুততা, প্রতিযোগিতা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য গ্রামীণ সহজ-সরল জীবনধারার বিপরীতে একটি নতুন সাংস্কৃতিক মানদণ্ড তৈরি করেছে।
- গ্রামীণ সংস্কৃতিতে শহুরে প্রভাব: গণমাধ্যম ও প্রযুক্তির প্রসারের কারণে শহুরে ফ্যাশন, জীবনধারা এবং খাদ্যাভ্যাস এখন গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থাৎ, গ্রামীণ ও শহুরে সংস্কৃতির মধ্যেকার পার্থক্য অনেকটাই কমে আসছে এবং একটি মিশ্র সাংস্কৃতিক ধারা তৈরি হচ্ছে।
- খাদ্যাভ্যাস ও পোশাক: ঐতিহ্যবাহী খাবার-দাবারের পাশাপাশি পশ্চিমা বা ফাস্ট ফুড এখন শহুরে জীবনে জনপ্রিয়। পোশাকে এসেছে ব্যাপক আধুনিকতা। ঐতিহ্যবাহী শাড়ি ও লুঙ্গির পাশাপাশি সেলোয়ার-কামিজ, জিন্স-টি-শার্ট এবং পশ্চিমা পোশাকের ব্যবহার বেড়েছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে।
৩. প্রযুক্তির প্রভাব ও সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন
প্রযুক্তি ও বিশ্বায়ন বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে যুক্ত করেছে এবং অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনেছে।
- গণমাধ্যম ও ইন্টারনেট বিপ্লব: টেলিভিশন, বিশেষত ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (Social Media) সংস্কৃতির প্রসারে বিপ্লব এনেছে। তরুণ প্রজন্ম এখন দেশি মিডিয়ার পাশাপাশি সহজেই বৈশ্বিক সংস্কৃতি, ভাষা ও জীবনধারা সম্পর্কে অবগত হচ্ছে। এটি একদিকে যেমন তাদের বিশ্ব নাগরিক হতে সাহায্য করছে, তেমনি অন্যদিকে নিজস্ব লোক-ঐতিহ্যের প্রতি মনোযোগ কমিয়ে দিচ্ছে।
- ভাষার পরিবর্তন: বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি এবং অন্যান্য ভাষার মিশ্রণ (বিশেষ করে ‘বাংলিশ’) তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যোগাযোগে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। বিদেশী সংস্কৃতির অনুকরণ এবং গ্লোবাল মিডিয়া ব্যবহারের কারণে দেশীয় ভাষার ব্যবহারে অনেক সময়ই শিথিলতা দেখা যায়।
- ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিবর্তন: বিশ্বায়নের প্রভাবে একদিকে যেমন ধর্মীয় কট্টরতা বা রক্ষণশীলতার উত্থান দেখা যাচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে ধর্মীয় সহনশীলতা ও সেক্যুলার মূল্যবোধের প্রতি আগ্রহও বাড়ছে। সমাজে এই দুই বিপরীতমুখী ধারার মধ্যে একটি স্পষ্ট সংঘাত পরিলক্ষিত হচ্ছে।
৪. শিল্পকলা ও বিনোদন জগতে নতুন ধারা
- সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র: ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীত বা ধ্রুপদী সঙ্গীতের পাশাপাশি ফিউশন, রক ও পপ সঙ্গীতের ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চলচ্চিত্র শিল্পে এখন আন্তর্জাতিক মানের প্রযোজনা এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। ইউটিউব ও ওটিটি (OTT) প্ল্যাটফর্মের উত্থান বিনোদনের মাধ্যমকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে।
- মেধাভিত্তিক সমাজের ধারণা: ঐতিহ্যগতভাবে সমাজে বয়সের ভিত্তিতে মর্যাদা নির্ধারিত হলেও, এখন শিক্ষা, মেধা ও অর্থনৈতিক সাফল্য সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণে মূল ভূমিকা পালন করছে। একজন সফল উদ্যোক্তা বা প্রযুক্তিবিদ গ্রামের মাতব্বর বা প্রথাগত নেতার চেয়েও বেশি সম্মান ও ক্ষমতা লাভ করতে পারেন।
উপসংহার
বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি এখন একটি রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং প্রযুক্তির প্রভাবে ব্যক্তি-স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং বিশ্বজনীনতার দিকে সমাজ ধাবিত হচ্ছে। তবে এই পরিবর্তনের সাথে সাথে পারিবারিক সংহতি হ্রাস, লোক-ঐতিহ্যের বিলুপ্তি এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের মতো কিছু চ্যালেঞ্জও তৈরি হচ্ছে। একটি সুস্থ সমাজ গঠনে এই পরিবর্তনশীল ধারাকে অবশ্যই ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে এগিয়ে যেতে হবে, যেখানে দেশীয় মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিশ্বায়নের সুবিধাগুলোর সাথে সমন্বিত হবে।