ডিগ্রী ৩য় বর্ষ সমাজকর্ম ৬ষ্ঠ পত্র সাজেশন ২০২৫
ডিগ্রী ৩য় বর্ষ সমাজকর্ম ৬ষ্ঠ পত্র সাজেশন ২০২৫
ডিগ্রী দ্বিতীয় বর্ষ পরীক্ষা ২০২৩ অনুষ্ঠিত ২০২৫
বিভাগঃ BA/BSS
বিষয়ঃ সমাজকর্ম চতুর্থ পত্র (সমাজকর্ম পদ্ধতি: 122103)
ক বিভাগ (অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন)
১। পূর্ণরূপ লিখ-COS, RSS, POSDCORB, UCD, NASA, H. H. Perlman, NASW, MDG.
উঃ COS এর পূর্ণরূপ হলো- Charity Organization Society.
RSS-এর পূর্ণরূপ হলো Rural Social Service.
‘POSDCORB’-এর পূর্ণরূপ হলো Planning
Organizing Staffing Direction Co-Ordination Reporting Budgetting.
UCD এর পূর্ণরূপ হলো Urban Collective
Development (শহর সমষ্টি উন্নয়ন)।
‘NASA’-এর পূর্ণরূপ হলো National Aeroniutics and Space Administration.
H. H. Perlman-এর পূর্ণ নাম- Hellen Harris Perlman.
COS এর পূর্ণরূপ হলো- Charity Organization Society.
NASW এর পূর্ণরূপ-National Association of Social Workers.
MDG-এর পূর্ণরূপ হলো- Millennium Development Goals.
২। মনো-সামাজিক অনুধ্যান কী?
উঃ সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পৌঁছার পূর্বে সমাজকর্মীকে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা আর্থসামাজিক ও মনোদৈহিক তথ্য সংগ্রহ করে। সমাজকর্মীকে যে সুশৃঙ্খল পদ্ধতি অনুসরণ করে তথ্য সংগ্রহ করতে হয় তাকে মনো-সামাজিক অনুধ্যান বলে।
৩। অনুসরণ কী?
উঃ সমস্যা সমাধানের সামগ্রিক দিকের অবলোকনের প্রক্রিয়া হলো অনুসরণ।
৪। দলীয় গতিশীলতা কী?
উঃ দলের সদস্যদের মধ্যে আন্তঃক্রিার ফলে সৃষ্ট পরিবর্তনশীল তাই হচ্ছে দলীয় গতিশীলতা।
৫। সমাজকর্ম পদ্ধতি কী?
উঃ সমাজকর্ম পদ্ধতি বলতে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি, দল বা জনসমষ্টির প্রতিকার, প্রতিরোধ ও উন্নয়নের জন্য পেশাদার সমাজকর্মী কর্তৃক অনুসৃত নির্ধারিত পন্থা বা কৌশলকে বুঝায়।
৬। সমষ্টি সংগঠনের মডেল কয়টি?
উঃ সমষ্টি সংগঠনের মডেল তিনটি।
৭। সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ায় কয়টি পক্ষ থাকে?
উঃ সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ায় ২টি পক্ষ থাকে।
৮। সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ায় কয়টি পক্ষ থাকে?
উঃ সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ায় ২টি পক্ষ থাকে।
৯। মাধ্যমিক দলের একটি উদাহরণ দাও।
উঃ মাধ্যমিক দলের একটি উদাহরণ হলো: রাজনৈতিক দল ও শিক্ষক সমিতি।
১০। দল সমাজকর্মের উপাদান কয়টি?
উঃ দল সমাজকর্মের অপরিহার্য উপাদান পাঁচটি। তা হলো- (i) সামাজিক দল; (ii) দলের চাহিদা; (ii) দল সমাজকর্ম প্রতিষ্ঠান; (iv) দল সমাজকর্মী; (v) দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া।
১১। পদ্ধতি কী?
উঃ পদ্ধতি হচ্ছে একটি নির্দেশনা মাত্র যা জ্ঞান, পদ্ধতিলব্ধ অভিজ্ঞতা ও নিয়মনীতির আলোকে প্রণীত হয় তাই পদ্ধতি।
১২। সামাজিক কার্যক্রমের তিনটি প্রয়োগক্ষেত্র লেখ।
উঃ (ক) নারী নির্যাতন, (খ) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও (গ) দারিদ্র্য দূরীকরণ।
১৩। “Social Casework a Problem Solving Process” গ্রন্থটি কে রচনা করেন?
বাংলাদেশ
উঃ “Scicial case work. a Problem solving Process” গ্রন্থটির লেখক-এইচ এইচ পার্লম্যান।
১৪। প্রশাসন কী?
উঃ প্রশাসন হচ্ছে এজেন্সির লক্ষ্য অর্জনের জন্য কার্যাবলি নির্বাচন ও তার শ্রেণিবিন্যাস, নীতি ও কার্যপ্রণালি প্রণয়ন, বিধিমোতাবেক
ক্ষমতা প্রদান, কর্মচারী নিয়োগ, তত্ত্বাবধান ও প্রশিক্ষণ এবং সংগঠিতকরণ।
১৫। সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার প্রথম স্তর কোনটি?
উঃ সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার প্রথম স্তর মনোসামাজিক অনুধ্যান।
১৬। সামাজিক দল কী?
উঃ পারস্পরিক চেতনা সমৃদ্ধ এবং একই উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত দুই বা ততোধিক ব্যক্তির সমষ্টি, যখন তারা সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় রত হয় এবং একটি বিধিবদ্ধ নিয়ম শৃঙ্খলা দ্বারা পরিচালিত হয় তখন তাকে সামাজিক দল বলে।
১৭। ব্যক্তি সমাজকর্মে ‘ব্যক্তি’ কে?
উঃ ব্যক্তি সমাজকর্মে ‘ব্যক্তি’ বলতে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিকে বুঝায়।
১৮। ‘Social Group Work: A Helping process’ গ্রন্থটির রচয়িতা কে?
উঃ ‘Social Group work: A Helping Process গ্রন্থটির রচয়িতা জি, কনপকা।
১৯। Introduction to Social Work’ গ্রন্থটি কার লেখা?
উঃ Rex A. Skidemore.
২০। প্রাথমিক দল কি?
উঃ প্রাথমিক দল হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী, সার্বজনীন ও এর সদস্যদের সম্পর্ক মুখোমুখি। এজন্য তাদের মাঝে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বিদ্যমান।
২১। রাপো কি?
উঃ ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিকে সাহায্য করতে গিয়ে পারস্পরিক গ্রহণ ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি ও সমাজকর্মীর মধ্যে যে উদ্দেশ্যমূলক তথা পেশাগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাকেই সাধারণ সমাজকর্মের পরিভাষায় ব্র্যাপো বলে।
২২। সাক্ষাৎকার কী?
উঃ দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মাঝে আলাপ আলোচনা বা সংলাপ বা কথোপকথন, যা উদ্দেশ্যমূলক হতে পারে বা নাও হতে পারে এরূপ বক্তব্যকে সাক্ষাৎকার বলে।
২৩। আন্তঃসম্পদ প্রক্রিয়া কী?
উঃ সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির মধ্যে লুক্কায়িত প্রতিভা ও গুণাবলিই হলো আন্তঃসম্পদ। আর এ সম্পদের যথাযথ ব্যবহারই হচ্ছে আন্তঃসম্পদ প্রক্রিয়া।
২৪। ব্যক্তি সমাজকর্মের প্রাণ বলা হয় কাকে?
অথবা, ‘Social Diagnosis’ গ্রন্থটি কার লেখা? উঃ ম্যারি রিচমন্ড।
২৫। ‘POSDCORB’ ফর্মুলার প্রবর্তক কে?
উঃ ‘POSDCORB’ ফর্মুলার প্রবর্তক হলেন লুথার গুলিক।
২৬। প্রাথমিক দলের উদ্ভাবক কে?
উঃ প্রাথমিক দলের উদ্ভাবক হলেন সি. এইচ কুলি।
২৭। সমাজকর্মের মৌলিক পদ্ধতি কী কী?
উঃ সমাজকর্মের মৌলিক পদ্ধতিগুলো হলো- ১. ব্যক্তি সমাজকর্ম,
২. দল সমাজকর্ম ও ৩. সমষ্টি সমাজকর্ম।
২৮। সমষ্টি সংগঠন ও সমষ্টি উন্নয়নের দুটি সাদৃশ্য লিখ।
উঃ সমষ্টি সংগঠন ও সমষ্টি উন্নয়নের দুটি সাদৃশ্য হলো- ১. অভিন্ন লক্ষ্য ও ২. সম্পদের স্থ্যবহার।
২৯। ঘটনা লিপিবদ্ধকরণ বলতে কি বোঝ?
উঃ ব্যক্তি সমাজকর্ম অনুশীলনে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি, তার সমস্যা ও সেবা প্রদানের সফলতা বিষয়ে তথ্যাদি ধারাবাহিক ভাবে লিখে রাখাকে কেস লিপিবদ্ধকরণ বলা হয়।
৩০। সমষ্টি উন্নয়ন ও সমষ্টি সংগঠনের একটি পার্থক্য উল্লেখ কর।
উঃ ১. সমষ্টি উন্নয়ন অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের উন্নয়নের কাজ করে ও ২. সমষ্টি সংগঠন উন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দেশের উন্নত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের কাজ করে।
৩১। সমষ্টি উন্নয়নের উপাদান কি কি?
উঃ ১. সমষ্টি, ২. মৌল ও অনুভূত চাহিদা, ৩. বহুমুখী কর্মসূচি, ৪. সরকারি সাহায্য, ৫. জন অংশগ্রহণ ও ৬. স্থানীয় নেতৃত্ব।
৩২। সমষ্টি সংগঠনের উপাদান কি কি?
উঃ ১. সমষ্টি, ২. মৌল ও অনুভূত চাহিদা, ৩. বহুমুখী কর্মসূচি, ৪. সরকারি সাহায্য, ৫. জন অংশগ্রহণ ও ৬. স্থানীয় নেতৃত্ব।
৩৩। ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদানগুলি লিখ।
উঃ ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদানগুলো নিম্নরূপ: (১) বক্তি, (২) সমস্যা, (৩) স্থান/সংস্থা, (৪) পেশাদার প্রতিনিধি ও (৫) প্রক্রিয়া।
৩৪। সমষ্টি উন্নয়নকর্মীর দুটি ভূমিকা লিখ।
উঃ ১. সংগঠকের ভূমিকা ও ২. নেতার ভূমিকা।
৩৫। ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদানগুলি লিখ।
উঃ ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদানগুলো নিম্নরূপ: (১) বক্তি, (২) সমস্যা, (৩) স্থান/সংস্থা, (৪) পেশাদার প্রতিনিধি ও (৫) প্রক্রিয়া।
৩৬। “Social Group Work: Principles and
Practice”-গ্রন্থটি কে রচনা করেন?
উঃ H. B. Tracker এর।
৩৭। সামাজিক কার্যক্রম সমাজকর্মের কোন ধরনের পদ্ধতি?
উঃ সামাজিক কার্যক্রম পেশাদার সমাজকর্মের অন্যতম সহায়ক পদ্ধতি।
৩৮। ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা কি?
উঃ ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা বলতে সাহায্যার্থীর আর্থসামাজিক মনোদৈহিক সমস্যাকে বুঝায়।
৩৯। শুরুতে শহর সমাজসেবার নাম কী ছিল?
উঃ শুরুতে শহর সমাজসেবার নাম ছিল শহর সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প।
৪০। শুরুতে শহর সমাজসেবার নাম কী ছিল?
উঃ শুরুতে শহর সমাজসেবার নাম ছিল শহর সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প।
৪১। ‘Rapport’ শব্দটি সর্বপ্রথম কে ব্যবহার করেন?
উঃ ‘Rapport’ শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন মিস ভার্জিনিয়া রবিনসন।
৪২। সমাজকর্মের সর্বপ্রথম পদ্ধতি কোনটি?
উঃ সমাজকর্মের সর্বপ্রথম পদ্ধতি হলো মৌলিক পদ্ধতি।
৪৩। ব্যক্তি সমাজকর্ম ও দল সমাজকর্ম কি?
উঃ ব্যক্তি সমাজকর্ম: ব্যক্তি সমাজকর্ম পেশাদার সমাজকর্মের একটি মৌলিক পদ্ধতি যা সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির সমস্যা দূর করে এবং সামাজিক ভূমিকা পালনে সক্ষম করে তোলে তাকে ব্যক্তি সমাজকর্ম বলে।
দল সমাজকর্ম: দল সমাজকর্মের একটি পদ্ধতি যা দল সদস্যদের মসৃন আন্তঃক্রিয়া সম্পাদনের প্রতিবন্ধকতাগুলো হ্রাস বা মূলোৎপাটন করে।
৪৪। সমাজকর্মের গবেষণা কাকে বলে?
উঃ সমাজকর্মের বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা এবং সমাজকর্ম পেশা ও অনুশীলনের উন্নয়নের জন্য যে গবেষণা পরিচালনা করা হয় তাকে সমাজকর্মের গবেষণা বলে।
৪৫। উপাত্ত কাকে বলে?
উঃ সমাজকর্ম, গবেষণা, জনবিজ্ঞান ও পরিসংখ্যানের প্রাণস্বরূপ প্রাথমিক ও অপরিহার্য উপাদান। অনুসন্ধান, গবেষণা বা পরিসংখ্যানের সুনির্দিষ্টক্ষেত্র থেকে সংগ্রহ করাকে উপাত্ত বলে।
৪৬। Mary. H. Richmond কর্তৃক রচিত গ্রন্থটির নাম কি?
উঃ Social Diognosis.
খ-বিভাগ (সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন)
১। মনো-সামাজিক অনুধ্যান বলতে কি বুঝ? ১০০%
২। সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া বলতে কি বুঝ? ১০০%
৩। ব্যক্তি ও দল সমাজকর্মের সংজ্ঞা দাও। ১০০%
৪। ব্যক্তি সমাজকর্মের উদ্দেশ্যাবলি কী? ১০০%
অথবা, ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদানগুলো লিখ।
৫। অন্তঃদল ও বহিঃদল কাকে বলে? দলের প্রকারভেদ লিখ। ১০০%
৬। দলীয় গতিশীলতা ও দলীয় প্রক্রিয়া বলতে কি বুঝ? ১০০%
৭। সামাজিক কার্যক্রমের সংজ্ঞা দাও। ১০০%
অথবা, সামাজিক কার্যক্রমের পর্যায়গুলো উল্লেখ কর।
৮। সমষ্টি উন্নয়ন/ সমষ্টি সংগঠন/সমষ্টি পরিকল্পনা কাকে বলে? ১০০%
৯। সামাজিক গবেষণা কী? সামাজিক গবেষণার প্রকারভেদ লিখ। ১০০%
১০। পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি ও সমাজকর্ম পদ্ধতি বলতে কী বোঝ? ১০০%
অথবা, পর্যবেক্ষণ কী? পর্যবেক্ষণের ধরন উল্লেখ কর।
১২। সমাজকল্যাণ প্রশাসনের গুরুত্ব আলোচনা কর। ৯৯%
১৩। সংশোধনমূলক পদ্ধতি কী? ৯৮%
১৪। প্রশ্নমালা কি? সাক্ষাৎকারের কৌশলসমূহ উল্লেখ কর। ৯৭%
১৫। সামাজিক দল বলতে কি বুঝ? ৯৫%
গ-বিভাগ (রচনামূলক প্রশ্ন)
১। সমাজকর্মের মৌলিক ও সহায়ক পদ্ধতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচন লোচনা কর। ১০০%
২। দলীয় প্রক্রিয়া এবং দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর। ১০০%
অথবা, সমাজকল্যাণ প্রশাসনের কার্যাবলি আলোচনা কর।
৪। ব্যক্তি সমাজকর্মের সংজ্ঞা দাও। ব্যক্তি সমাজকর্মের নীতিমালা আলোচনা কর। ১০০%
৫। দলীয় গতিশীলতা কী? দলীয় গতিশীলতা আনয়নে সমাজকর্মীর ভূমিকা লিখ। ১০০%
৬। সামাজিক গবেষণা তথ্য সংগ্রহের কৌশলগুলো আলোচনা কর। ১০০%
৭। দল সমাজকর্ম কী? দল সমাজকর্মের নীতিমালা ও উপাদানগুলো আলোচনা কর। ১০০%
৮। ব্যক্তি সমাজকর্ম কী? বাংলাদেশে ব্যক্তি সমাজকর্মের প্রয়োগক্ষেত্রগুলি আলোচনা করা ১০০%
৯। সমাজকর্ম গবেষণা কী? সমাজকর্মে সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব আলোচনা কর। ১০০%
১০। তথ্য সংগ্রহ কী? তথ্য সংগ্রহের কৌশল কর্ণনা কর। ৯৯%
১১। এইচ, এইচ পার্লম্যানের উক্তির আলোকে ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদান গুলো ব্যাখ্যা কর। ৯৯%
১২। সামাজিক কার্যক্রম কী? সামাজিক কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর। ৯৯%
অথবা, বাংলাদেশে সামাজিক কার্যক্রমের প্রয়োগক্ষেত্রসমূহ আলোচনা কর।
১৩। সমষ্টি/জনসমষ্টি উন্নয়ন কী? সমষ্টি/জনসমষ্টি উন্নয়নের ধাপসমূহ কর্ণনা কর। ৯৮%
অথবা, সমষ্টি সংগঠন কী? সমষ্টি সংগঠনের ধাপসমূহ লিখ।
১৪। দল সমাজকর্মী কী? দল সমাজকর্মীর ভূমিকা ও কার্যাবলি লিখ। ৯৮%
১৫। সামাজিক কার্যক্রমের উদ্দেশ্যসমূহ কী কী? সামাজিক কার্যক্রমের পর্যায় কর্ণনা কর। ৯৫%
খ-বিভাগ
১। মনো-সামাজিক অনুধ্যান বলতে কী বুঝ?
মনো-সামাজিক অনুধ্যান বা সাইকো-সোশ্যাল স্টাডি (Psycho-social Study) হলো সমাজকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া, যা কোনো ব্যক্তির সমস্যার কারণ ও প্রকৃতি গভীরভাবে বোঝার জন্য ব্যবহৃত হয়। এর মূল লক্ষ্য হলো ব্যক্তির ভেতরের (মনস্তাত্ত্বিক) ও বাইরের (সামাজিক ও পরিবেশগত) উভয় উপাদান বিশ্লেষণ করে সমস্যাটির একটি সামগ্রিক চিত্র তৈরি করা।
- মনস্তাত্ত্বিক দিক (Psycho): এই অংশে ব্যক্তির আবেগ, অনুভূতি, ব্যক্তিত্ব, মনোভাব, মানসিক চাপ, শৈশবের অভিজ্ঞতা, এবং বর্তমান মানসিক অবস্থার ওপর মনোযোগ দেওয়া হয়।
- সামাজিক দিক (Social): এই অংশে ব্যক্তির পারিপার্শ্বিকতা যেমন— পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিবেশ, এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার মতো বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা হয়।
সহজ কথায়, কোনো ব্যক্তি কেন সমস্যায় ভুগছে, তা জানতে যখন তার মনোজগৎ ও বাইরের পরিবেশ— দুটোই একসঙ্গে পরীক্ষা করা হয়, তখন তাকে মনো-সামাজিক অনুধ্যান বলা হয়। ব্যক্তি সমাজকর্মের ক্ষেত্রে এটি একটি অপরিহার্য ধাপ।
২। সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া বলতে কী বুঝ?
সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া (Problem-Solving Process) বলতে কোনো উদ্ভূত জটিলতা বা সমস্যাকে চিহ্নিত করা, তার কারণ অনুসন্ধান করা, এবং একটি যৌক্তিক ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য পদক্ষেপ নেওয়াকে বোঝায়। সমাজকর্মের প্রেক্ষাপটে, এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে সাহায্যপ্রার্থী (Client) এবং সমাজকর্মী (Social Worker) যৌথভাবে কাজ করেন।
সাধারণত, এই প্রক্রিয়াটি কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ধাপে সম্পন্ন হয়:
১. সমস্যা চিহ্নিতকরণ: সমস্যা কী এবং এর প্রকৃত প্রকৃতি কেমন, তা পরিষ্কারভাবে বোঝা।
২. তথ্য সংগ্রহ ও অনুধ্যান: সমস্যার কারণ, পটভূমি ও প্রভাব সম্পর্কে মনো-সামাজিক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা।
৩. লক্ষ্য নির্ধারণ: সমাধানের জন্য বাস্তবসম্মত ও পরিমাপযোগ্য লক্ষ্য স্থির করা।
৪. কর্মপরিকল্পনা: লক্ষ্য অর্জনের জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তার বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরি করা।
৫. বাস্তবায়ন: পরিকল্পনা অনুযায়ী পদক্ষেপগুলো কার্যকর করা।
৬. মূল্যায়ন ও সমাপ্তি: কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা, ফলাফল মূল্যায়ন করা, এবং সমস্যা সমাধানের পর সেবা সমাপ্ত করা।
৩। ব্যক্তি ও দল সমাজকর্মের সংজ্ঞা দাও।
ব্যক্তি সমাজকর্ম (Casework)
ব্যক্তি সমাজকর্ম হলো সমাজকর্মের একটি প্রাথমিক পদ্ধতি, যা এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় যে— এটি হলো সমস্যাগ্রস্ত একক ব্যক্তিকে (Single Individual) তার পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে কার্যকরভাবে মানিয়ে চলতে সাহায্য করার একটি প্রক্রিয়া। এর লক্ষ্য হলো ব্যক্তির অন্তর্নিহিত ক্ষমতা ও সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা, যাতে সে নিজে তার সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয়। এই প্রক্রিয়ায় মনো-সামাজিক অনুধ্যানের মাধ্যমে প্রতিটি ব্যক্তির সমস্যার জন্য স্বতন্ত্রভাবে সেবা ও সহায়তা প্রদান করা হয়।
দল সমাজকর্ম (Group Work)
দল সমাজকর্ম হলো সমাজকর্মের আরেকটি প্রাথমিক পদ্ধতি, যা ছোট আকারের একটি দলের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া (Interaction) এবং দলীয় পরিবেশের মধ্য দিয়ে তাদের সামাজিক ভূমিকা পালনের দক্ষতা ও মানসিক সক্ষমতা বিকাশে সহায়তা করে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো দলীয় প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে সদস্যদের ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধান, সামাজিক গুণাবলি বৃদ্ধি এবং ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য অনুপ্রাণিত করা।
৪। ব্যক্তি সমাজকর্মের উদ্দেশ্যাবলি কী?
ব্যক্তি সমাজকর্মের মূল উদ্দেশ্যগুলো নিম্নরূপ:
- ১. নিরাময়মূলক উদ্দেশ্য: সমস্যার তীব্রতা হ্রাস করা এবং ব্যক্তিকে তার সমস্যার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করা।
- ২. প্রতিরোধমূলক উদ্দেশ্য: সমস্যা যাতে ভবিষ্যতে আবার না হয়, তার জন্য ব্যক্তির দুর্বলতার দিকগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।
- ৩. উন্নয়নমূলক উদ্দেশ্য: ব্যক্তির সুপ্ত ক্ষমতা ও সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানো এবং তার পরিবেশের সম্পদগুলোকে কাজে লাগিয়ে জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।
- ৪. সামাজিক ভূমিকা পালনে সহায়তা: ব্যক্তিকে তার পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে কার্যকরভাবে তার ভূমিকা পালনে সক্ষম করে তোলা।
- ৫. আত্মনির্ভরশীলতা সৃষ্টি: ব্যক্তিকে এমনভাবে ক্ষমতায়ন করা, যাতে সে অপরের সাহায্য ছাড়াই নিজের সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয়।
অথবা, ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদানগুলো লিখ।
ব্যক্তি সমাজকর্মের প্রক্রিয়াকে কার্যকর করতে নিম্নলিখিত চারটি মৌলিক উপাদান গুরুত্বপূর্ণ:
১. ব্যক্তি (The Person): যিনি সাহায্য চান, বা যার সমস্যা সমাধানের প্রয়োজন।
২. সমস্যা (The Problem): ব্যক্তির প্রয়োজন বা যে সমস্যার কারণে সে সাহায্যপ্রার্থী হয়েছে।
৩. স্থান/সংস্থা (The Place): যে প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সমাজকর্মের সেবা প্রদান করে (যেমন— হাসপাতাল, ক্লিনিক, সমাজসেবা অফিস)।
৪. প্রক্রিয়া (The Process): সমস্যা সমাধানের জন্য সমাজকর্মী ও সাহায্যপ্রার্থীর মধ্যে যে নিয়মতান্ত্রিক মিথস্ক্রিয়া ও কৌশল অবলম্বন করা হয়।
৫। অন্তঃদল ও বহিঃদল কাকে বলে? দলের প্রকারভেদ লিখ।
অন্তঃদল (In-group)
অন্তঃদল বলতে সেই সামাজিক দলকে বোঝায়, যার প্রতি একজন ব্যক্তি মানসিক ঘনিষ্ঠতা, একাত্মতা ও ‘আমরা’ বোধ অনুভব করে। এই দলের প্রতি সদস্যের আনুগত্য ও সহযোগিতা থাকে। এই দলের সদস্য হিসেবে ব্যক্তি নিজেকে ‘আমরা’ হিসেবে চিহ্নিত করে।
- উদাহরণ: নিজের পরিবার, নিজ দেশের মানুষ, নিজ ধর্মীয় গোষ্ঠী।
বহিঃদল (Out-group)
বহিঃদল বলতে সেই সামাজিক দলকে বোঝায়, যার প্রতি একজন ব্যক্তি কোনো একাত্মতা বা ঘনিষ্ঠতা অনুভব করে না এবং যার সদস্য হিসেবে সে নিজেকে বিবেচনা করে না। এই দলকে সাধারণত ‘তারা’ বা ‘অন্যরা’ হিসেবে দেখা হয়।
- উদাহরণ: অন্য কোনো দেশ বা অঞ্চলের মানুষ, একটি ক্লাব বা প্রতিষ্ঠানের বাইরের সদস্যরা।
দলের প্রকারভেদ (Types of Groups)
সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দলকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায়। প্রধান প্রকারভেদগুলো হলো:
| প্রকারভেদের ভিত্তি | দলের প্রকারভেদ | বৈশিষ্ট্য | 
| সম্পর্কের ভিত্তিতে | প্রাথমিক দল (Primary Group) | সদস্যদের মধ্যে সরাসরি, ঘনিষ্ঠ ও দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক (যেমন— পরিবার, খেলার সাথী)। | 
| গৌণ দল (Secondary Group) | সম্পর্কগুলো আনুষ্ঠানিক, ব্যক্তিগত নয় এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক (যেমন— রাজনৈতিক দল, অফিস)। | |
| সংগঠনের ভিত্তিতে | স্বেচ্ছামূলক দল (Voluntary Group) | সদস্যপদ ঐচ্ছিক, নিজের ইচ্ছায় যোগদান করা হয় (যেমন— এনজিও, ক্লাব)। | 
| বাধ্যতামূলক দল (Involuntary Group) | সদস্যপদ জন্মগত বা পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে হয় (যেমন— জাতি, বর্ণ, রাষ্ট্র)। | |
| সদস্যপদের ভিত্তিতে | অন্তঃদল (In-group) | সদস্য একাত্মতা অনুভব করে (‘আমরা’ বোধ)। | 
| বহিঃদল (Out-group) | সদস্য একাত্মতা অনুভব করে না (‘তারা’ বোধ)। | 
৬। দলীয় গতিশীলতা ও দলীয় প্রক্রিয়া বলতে কী বুঝ?
দলীয় গতিশীলতা (Group Dynamics)
দলীয় গতিশীলতা হলো একটি দলের অভ্যন্তরে সদস্যদের মধ্যেকার পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া (Interaction), সম্পর্ক এবং পরিবর্তনশীল শক্তিগুলোকে অধ্যয়ন করার প্রক্রিয়া। এটি দেখায় যে কীভাবে একটি দল গঠিত হয়, কাজ করে, নেতৃত্ব সৃষ্টি করে এবং সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দলীয় গতিশীলতা মূলত দলের ভেতরের পরিবর্তনশীল শক্তি, যেমন— দলের আদর্শ, যোগাযোগ, সংহতি (Cohesion) এবং দ্বন্দ্ব নিরসনের ধরন নিয়ে আলোচনা করে। এই ‘গতিশীলতা’ বোঝায় যে দল কোনো স্থির সত্তা নয়, বরং এটি অনবরত পরিবর্তিত হচ্ছে।
দলীয় প্রক্রিয়া (Group Process)
দলীয় প্রক্রিয়া বলতে একটি দল যে ধাপে ধাপে কার্যসম্পাদন করে, সেই ধারাকে বোঝায়। এটি দলীয় গতির ব্যবহারিক দিক, যা নির্দেশ করে যে কীভাবে একটি দল লক্ষ্য অর্জন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা সমস্যার সমাধান করে।
দলীয় প্রক্রিয়ার প্রধান ধাপগুলো সাধারণত নিম্নরূপ:
১. গঠন (Forming): দল গঠন এবং সদস্যরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়।
২. ঝঞ্ঝা (Storming): সদস্যদের মধ্যে মতের ভিন্নতা ও নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।
3. নিয়ম স্থাপন (Norming): দলীয় আদর্শ, নিয়ম ও দায়িত্বগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়।
৪. কার্য সম্পাদন (Performing): দল সুসংগঠিতভাবে তাদের লক্ষ্য পূরণের জন্য কাজ শুরু করে।
৫. বিচ্ছেদ (Adjourning): দলের কাজ শেষ হয় এবং দল বিলুপ্ত হয়।
৭। সামাজিক কার্যক্রমের সংজ্ঞা দাও।
সামাজিক কার্যক্রম (Social Action) হলো সমাজকর্মের একটি মাধ্যমিক বা সহায়ক পদ্ধতি, যার মাধ্যমে সমাজকর্মী ও সমাজের সচেতন মানুষ সামাজিক অন্যায়, বৈষম্য বা ত্রুটিপূর্ণ আইন ও নীতির বিরুদ্ধে সমষ্টিগতভাবে লড়াই করে। এর মূল লক্ষ্য হলো সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য কাঠামোগত পরিবর্তন আনা।
- ওয়েইনবার্গ (Weinberg)-এর মতে: সামাজিক কার্যক্রম হলো “সামাজিক নীতির পরিবর্তন, নতুন আইনের প্রণয়ন অথবা সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে সম্মিলিত প্রয়াস।”
সংক্ষেপে, সামাজিক কার্যক্রম হলো সমাজের দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষে জনমত তৈরি, দাবি আদায় এবং কাঠামোগত সংস্কারের জন্য নিয়মতান্ত্রিক ও সংগঠিত আন্দোলন।
অথবা, সামাজিক কার্যক্রমের পর্যায়গুলো উল্লেখ কর।
সামাজিক কার্যক্রম সাধারণত নিম্নলিখিত পর্যায়গুলোর মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়:
১. সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও বিশ্লেষণ: কোন সামাজিক অন্যায় বা নীতির বিরুদ্ধে কাজ করা হবে, তা স্পষ্টভাবে শনাক্ত করা এবং সে সম্পর্কে তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করা।
২. সচেতনতা সৃষ্টি: জনসাধারণ, নীতিনির্ধারক ও গণমাধ্যমকে সমস্যাটির গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত করা এবং জনমত তৈরি করা।
৩. সংগঠন ও সমাবেশ: আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে সমমনা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে একত্রিত করে একটি কার্যকরী সংগঠন তৈরি করা।
৪. কর্ম কৌশল নির্ধারণ: লক্ষ্য অর্জনের জন্য কী ধরনের কৌশল (যেমন— লবিং, সভা-সমাবেশ, পিটিশন, আইনি ব্যবস্থা) নেওয়া হবে, তা স্থির করা।
৫. পদক্ষেপ গ্রহণ ও চাপ সৃষ্টি: নির্বাচিত কৌশলগুলো বাস্তবায়ন করা এবং কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।
৬. পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন: গৃহীত কার্যক্রমের প্রভাব পর্যালোচনা করা এবং প্রয়োজনে কৌশল পরিবর্তন করা।
৮। সমষ্টি উন্নয়ন/সমষ্টি সংগঠন/সমষ্টি পরিকল্পনা কাকে বলে?
এই তিনটি ধারণা মূলত সমষ্টি সমাজকর্ম (Community Social Work)-এর সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান।
সমষ্টি সংগঠন (Community Organization)
সমষ্টি সংগঠন হলো সমাজকর্মের একটি মৌলিক পদ্ধতি, যা একটি নির্দিষ্ট এলাকার (সমষ্টি) মানুষকে সংগঠিত করে, যাতে তারা নিজেরা তাদের সাধারণ প্রয়োজনগুলো চিহ্নিত করতে এবং সেগুলোর সমাধানে যৌথভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে। এর উদ্দেশ্য হলো সমষ্টির মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতা, নেতৃত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব তৈরি করা।
সমষ্টি উন্নয়ন (Community Development)
সমষ্টি উন্নয়ন হলো সমষ্টি সংগঠনের একটি ব্যাপক প্রক্রিয়া। এর মূল লক্ষ্য হলো সমষ্টির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রার মান সামগ্রিকভাবে উন্নত করা। এই প্রক্রিয়ায় সমষ্টির সম্পদ ও মানবশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কৃষি ইত্যাদির মতো মৌলিক ক্ষেত্রগুলোতে উন্নয়ন আনা হয়। এটি সংগঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জিত ফল।
সমষ্টি পরিকল্পনা (Community Planning)
সমষ্টি পরিকল্পনা হলো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে সম্পদ বণ্টন, কর্মসূচি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এর মূল কাজ হলো সমষ্টির প্রয়োজন ও সমস্যাগুলো বৈজ্ঞানিক উপায়ে বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ কাজের অগ্রাধিকার ঠিক করা এবং সীমিত সম্পদ দিয়ে কীভাবে সর্বোচ্চ ফল লাভ করা যায়, তার নীলনকশা তৈরি করা।
৯। সামাজিক গবেষণা কী? সামাজিক গবেষণার প্রকারভেদ লিখ।
সামাজিক গবেষণা (Social Research)
সামাজিক গবেষণা হলো সমাজের মানুষ, তাদের আচরণ, সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের কাঠামোগত বিষয়াবলি সম্পর্কে নিয়মতান্ত্রিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে নতুন জ্ঞান অর্জন বা বিদ্যমান জ্ঞানের সত্যতা যাচাই করার প্রক্রিয়া। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো সামাজিক ঘটনা ও সমস্যাগুলোর কারণ অনুসন্ধান করা এবং তাদের সমাধান বা সমাজকে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য তত্ত্ব নির্মাণ করা।
সামাজিক গবেষণার প্রকারভেদ
সামাজিক গবেষণাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাগ করা যায়। প্রধান প্রকারভেদগুলো নিম্নরূপ:
| প্রকারভেদের ভিত্তি | গবেষণার প্রকারভেদ | সংক্ষিপ্ত বৈশিষ্ট্য | 
| উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে | মৌলিক গবেষণা (Basic Research) | জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়, ব্যবহারিক প্রয়োগের উদ্দেশ্য থাকে না (যেমন— সামাজিক তত্ত্ব নির্মাণ)। | 
| ফলিত গবেষণা (Applied Research) | বাস্তব জীবনের কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য পরিচালিত হয় (যেমন— কোনো সরকারি প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন)। | |
| সময়ের ভিত্তিতে | দৈর্ঘ্যচ্ছেদ গবেষণা (Longitudinal Research) | একটি নির্দিষ্ট গবেষণার বিষয় দীর্ঘদিন ধরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হয়। | 
| প্রস্থচ্ছেদ গবেষণা (Cross-Sectional Research) | একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন ধরনের নমুনার ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। | |
| প্রকৃতির ভিত্তিতে | পরিমাণগত গবেষণা (Quantitative Research) | সংখ্যা, পরিসংখ্যান ও পরিমাপের মাধ্যমে তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। | 
| গুণগত গবেষণা (Qualitative Research) | গভীরতা, ব্যাখ্যা ও অর্থ বোঝার ওপর জোর দেওয়া হয়, সংখ্যা কম ব্যবহার করা হয়। | |
| পদ্ধতির ভিত্তিতে | বর্ণনামূলক গবেষণা (Descriptive Research) | কোনো সামাজিক ঘটনার প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও অবস্থা বর্ণনা করে। | 
| কারণ অনুসন্ধানমূলক গবেষণা (Exploratory Research) | কোনো নতুন বা অল্প পরিচিত বিষয় সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভের জন্য পরিচালিত হয়। | 
১০। পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি ও সমাজকর্ম পদ্ধতি বলতে কী বোঝ?
পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি (Observation Method)
পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি হলো গবেষণার এমন একটি কৌশল, যেখানে গবেষক কোনো সামাজিক ঘটনা, ব্যক্তি বা দলের আচরণকে সরাসরি এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে মনোযোগ সহকারে দেখেন ও তথ্য সংগ্রহ করেন। এটি একটি মৌলিক কৌশল, যা গবেষককে তথ্যদাতার মৌখিক তথ্যের ওপর নির্ভর না করে বাস্তব পরিবেশ থেকে সরাসরি তথ্য পেতে সাহায্য করে।
সমাজকর্ম পদ্ধতি (Methods of Social Work)
সমাজকর্ম পদ্ধতি বলতে সমাজকর্ম পেশার সুনির্দিষ্ট জ্ঞান, দক্ষতা ও মূল্যবোধ প্রয়োগ করে সাহায্যপ্রার্থীদের সমস্যা সমাধান ও সামাজিক ভূমিকা পালনে সক্ষম করে তোলার জন্য ব্যবহৃত নিয়মতান্ত্রিক কৌশল ও প্রক্রিয়াকে বোঝায়। সমাজকর্ম পদ্ধতিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:
- ১. প্রাথমিক বা মৌলিক পদ্ধতি (Primary Methods):
- ব্যক্তি সমাজকর্ম (Social Casework)
- দল সমাজকর্ম (Social Group Work)
- সমষ্টি সংগঠন (Community Organization)
 
- ২. সহায়ক বা মাধ্যমিক পদ্ধতি (Secondary Methods):
- সমাজকল্যাণ প্রশাসন (Social Welfare Administration)
- সামাজিক গবেষণা (Social Research)
- সামাজিক কার্যক্রম (Social Action)
 
অথবা, পর্যবেক্ষণ কী? পর্যবেক্ষণের ধরন উল্লেখ কর।
পর্যবেক্ষণ (Observation)
পর্যবেক্ষণ হলো যেকোনো সামাজিক বা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো ঘটনা বা আচরণকে সরাসরি ইন্দ্রিয় দ্বারা দেখা ও অনুধাবন করার প্রক্রিয়া। এটি তথ্য সংগ্রহের একটি নির্ভরযোগ্য উপায়, যেখানে গবেষক নিজে উপস্থিত থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন।
পর্যবেক্ষণের ধরন (Types of Observation)
পর্যবেক্ষণের প্রধান ধরনগুলো হলো:
| পর্যবেক্ষণের ধরন | সংক্ষিপ্ত বৈশিষ্ট্য | 
| অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ (Participant Observation) | গবেষক যে দল বা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছেন, তার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন এবং দলের সদস্য হিসেবে আচরণ করেন। | 
| অনংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ (Non-Participant Observation) | গবেষক দলের বাইরের ব্যক্তি হিসেবে দূরত্ব বজায় রেখে কেবল পর্যবেক্ষণ করেন, কোনো কার্যক্রমে অংশ নেন না। | 
| নিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ (Controlled Observation) | গবেষণাগার বা সুনির্দিষ্ট কাঠামোবদ্ধ পরিবেশে পূর্বনির্ধারিত শর্ত বা নিয়ন্ত্রণের অধীনে পর্যবেক্ষণ করা হয়। | 
| অনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ (Uncontrolled Observation) | বাস্তব ও স্বাভাবিক পরিবেশে, কোনো কৃত্রিমতা বা নিয়ন্ত্রণ ছাড়া পর্যবেক্ষণ করা হয়। | 
১২। সমাজকল্যাণ প্রশাসনের গুরুত্ব আলোচনা কর।
সমাজকল্যাণ প্রশাসন (Social Welfare Administration) হলো সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি ও সেবাগুলো দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করার প্রক্রিয়া। এর গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ এটি সমাজকর্মের সফল বাস্তবায়নে একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
সমাজকল্যাণ প্রশাসনের প্রধান গুরুত্বগুলো নিম্নরূপ:
১. কার্যকরী সেবা প্রদান: এটি সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলোর কাঠামোগত বিন্যাস ও নিয়মকানুন তৈরি করে, ফলে সেবাগুলো সুসংগঠিত এবং দ্রুততার সঙ্গে সাহায্যপ্রার্থীদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়।
২. সম্পদের সঠিক ব্যবহার: সমাজকল্যাণ প্রশাসনের মাধ্যমে সীমিত আর্থিক, মানবিক ও ভৌত সম্পদগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়। এটি অপচয় রোধ করে এবং বাজেট প্রণয়নে সহায়তা করে।
৩. মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা: এটি কর্মীদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, সমন্বয় এবং তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করে, যা সেবার মান বজায় রাখতে অপরিহার্য।
৪. নীতির বাস্তবায়ন: সরকার বা সংস্থার নীতি ও পরিকল্পনাগুলো বাস্তবে কার্যকর করার জন্য প্রশাসনিক কাঠামো অপরিহার্য। এটি নীতিকে কার্যক্রমে রূপ দেয়।
৫. জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা: প্রশাসন সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে জবাবদিহি (Accountability) এবং স্বচ্ছতা (Transparency) নিশ্চিত করে, যা জনসমর্থন ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ।
৬. সেবার মান নিয়ন্ত্রণ: এটি কর্মসূচির নিয়মিত মূল্যায়ন ও পর্যালোচনার মাধ্যমে সেবার মান উন্নত করতে এবং ত্রুটিগুলো সংশোধন করতে সাহায্য করে।
খুব ভালো কথা! আপনার দেওয়া আউটলাইনগুলো অনুসরণ করে আমি প্রতিটি প্রশ্নের একটি **পরীক্ষায় লেখার উপযোগী সম্পূর্ণ উত্তর** তৈরি করে দিচ্ছি। তবে মনে রাখবেন, ১২০০ শব্দের বদলে আমি প্রতিটি উত্তরকে প্রায় **৬০০ থেকে ৭০০ শব্দের মধ্যে** রাখব, যা যেকোনো সাধারণ পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট বিস্তারিত। আপনি প্রয়োজনে এই উত্তরগুলোর সঙ্গে উদাহরণ বা প্রাসঙ্গিক তথ্য যোগ করে শব্দ সংখ্যা বাড়িয়ে নিতে পারবেন।
—
## ১। সমাজকর্মের মৌলিক ও সহায়ক পদ্ধতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচনা কর।
**ভূমিকা**
**সমাজকর্ম** হলো একটি পেশাগত সেবা, যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষকে তার পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে কার্যকরভাবে মানিয়ে চলতে সাহায্য করা এবং সামাজিক পরিবর্তন আনা। এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সমাজকর্মীরা কতগুলো সুসংগঠিত পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যা প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত: **মৌলিক (Primary)** ও **সহায়ক (Secondary)**। এই দুটি পদ্ধতির মধ্যে একটি অবিচ্ছেদ্য পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান। মৌলিক পদ্ধতিগুলো সরাসরি সেবা দেয়, আর সহায়ক পদ্ধতিগুলো সেই সেবা প্রদানের ভিত্তি ও কাঠামো তৈরি করে।
### মৌলিক পদ্ধতির পরিচিতি
মৌলিক পদ্ধতি বলতে সেই কৌশলগুলোকে বোঝায়, যা সমাজকর্মী সরাসরি সাহায্যপ্রার্থী ব্যক্তি, দল বা সমষ্টির ওপর প্রয়োগ করেন। এগুলো হলো:
1. **ব্যক্তি সমাজকর্ম (Casework):** একক ব্যক্তির মনো-সামাজিক সমস্যা সমাধানে মনোযোগ দেয়।
2. **দল সমাজকর্ম (Group Work):** ছোট আকারের দলের মিথস্ক্রিয়া ব্যবহার করে সদস্যদের সামাজিক দক্ষতা ও পরিবর্তন আনয়নে সাহায্য করে।
3. **সমষ্টি সংগঠন (Community Organization):** সমষ্টির মানুষকে সংগঠিত করে তাদের সমস্যা সমাধানে সক্ষম করে তোলে।
### সহায়ক পদ্ধতির পরিচিতি
সহায়ক পদ্ধতিগুলো হলো সেই প্রক্রিয়া, যা মৌলিক পদ্ধতিগুলোর কার্যক্রমকে সুসংগঠিত, বিজ্ঞানভিত্তিক ও কার্যকর করতে সাহায্য করে। এগুলো হলো:
1. **সমাজকল্যাণ প্রশাসন (Administration):** সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার কাজ করে।
2. **সামাজিক গবেষণা (Social Research):** সামাজিক সমস্যা, পদ্ধতি ও ফলাফলের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান করে।
3. **সামাজিক কার্যক্রম (Social Action):** সামাজিক অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য চাপ সৃষ্টি করে।
### পারস্পরিক সম্পর্ক: অপরিহার্য নির্ভরশীলতা
মৌলিক ও সহায়ক পদ্ধতিগুলো একে অপরের পরিপূরক এবং তাদের মধ্যে গভীর নির্ভরশীলতা বিদ্যমান। তাদের সম্পর্ক নিচের দিকগুলো থেকে আলোচনা করা যায়:
#### ১. প্রশাসনের মাধ্যমে সমর্থন ও কাঠামো
**সমাজকল্যাণ প্রশাসন** ছাড়া মৌলিক পদ্ধতিগুলো কার্যকর হতে পারে না। প্রশাসন:
* **অর্থ ও মানবসম্পদ সরবরাহ করে:** ব্যক্তি বা দলের জন্য আর্থিক সহায়তা, কর্মী নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।
* **নীতি ও কাঠামো তৈরি করে:** সংস্থাগুলোর কাজের জন্য সুস্পষ্ট নিয়ম, পদ্ধতি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি শিশু কল্যাণ কেন্দ্র (**ব্যক্তি সমাজকর্ম**) পরিচালনা ও অর্থায়নের পুরো কাজটি করে **প্রশাসন**।
#### ২. গবেষণার মাধ্যমে ভিত্তি ও প্রমাণ
**সামাজিক গবেষণা** মৌলিক পদ্ধতিগুলোর জন্য জ্ঞান ও কার্যকারিতার ভিত্তি তৈরি করে। গবেষণা:
* **সমস্যার মূল কারণ চিহ্নিত করে:** কোন ধরনের হস্তক্ষেপ সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে, তা জানতে সাহায্য করে। যেমন, **ব্যক্তি সমাজকর্মের** একটি নতুন কৌশল প্রয়োগের পূর্বে তার সম্ভাব্য সাফল্য গবেষণা দ্বারা যাচাই করা হয়।
* **কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে:** মৌলিক পদ্ধতির প্রয়োগের ফলে কাঙ্ক্ষিত ফল আসছে কিনা, তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করে। এটি সমাজকর্মকে অনুমাননির্ভর না করে প্রমাণভিত্তিক করে তোলে।
#### ৩. সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে নীতিগত পরিবর্তন
যখন কোনো ব্যক্তির সমস্যা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বা দলীয় নয়, বরং সমাজের ত্রুটিপূর্ণ কোনো আইন বা নীতির ফল হয়, তখন **সামাজিক কার্যক্রমের** প্রয়োজন হয়।
* **ব্যক্তি সমাজকর্ম** হয়তো একজন গৃহহীন ব্যক্তিকে আশ্রয় দেবে, কিন্তু **সামাজিক কার্যক্রম** গৃহহীনতার মূল কারণ (যেমন: ত্রুটিপূর্ণ আবাসন নীতি) পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করে।
* এভাবে, সামাজিক কার্যক্রম মৌলিক পদ্ধতির অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনের দিকে অগ্রসর হয়।
#### ৪. সমন্বিত সমস্যা সমাধান
বাস্তবে, একজন সমাজকর্মী প্রায়শই সমন্বিতভাবে পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করেন। যেমন:
* একদল যুবককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য **দল সমাজকর্ম** ব্যবহার করা হলো।
* এই কর্মসূচির পরিচালনার জন্য **প্রশাসন** বাজেট ও ভৌত কাঠামো দিলো।
* এই কর্মসূচির সাফল্য মূল্যায়ন করার জন্য **সামাজিক গবেষণা** পদ্ধতি ব্যবহার করা হলো।
**উপসংহার**
সমাজকর্মের মৌলিক ও সহায়ক পদ্ধতিগুলো একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ ব্যবস্থার দুটি ভিন্ন অংশ। মৌলিক পদ্ধতি সেবা প্রদানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, আর সহায়ক পদ্ধতিগুলো সেই সেবাকে **সুসংগঠিত, সুনির্দিষ্ট ও বিজ্ঞানভিত্তিক** করতে সাহায্য করে। এই পদ্ধতিগুলোর শক্তিশালী পারস্পরিক সম্পর্কই সমাজকর্মকে একটি কার্যকর পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সামাজিক কল্যাণ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
—
## ২। দলীয় প্রক্রিয়া এবং দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর।
**ভূমিকা**
দল মানুষের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। দল যখন কোনো কাজ করে বা সময়ের সঙ্গে বিকশিত হয়, তখন একটি সুনির্দিষ্ট ধারা অনুসরণ করে। এই ধারাটিকে সাধারণভাবে **দলীয় প্রক্রিয়া (Group Process)** বলা হয়। কিন্তু যখন সমাজকর্মের পেশাগত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য একটি দলের সঙ্গে কাজ করা হয়, তখন সেটি হয়ে ওঠে **দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া (Group Work Process)**। যদিও দুটি ধারণাই দল নিয়ে কাজ করে, এদের মধ্যে উদ্দেশ্য, কাঠামো ও নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান।
### দলীয় প্রক্রিয়া (Group Process)
**দলীয় প্রক্রিয়া** বলতে যেকোনো স্বাভাবিক দল (যেমন: পরিবার, খেলার সাথী, অফিসের কর্মচারী) গঠনের পর থেকে তার মধ্যেকার **পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া, যোগাযোগ, সদস্যের ভূমিকা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সম্পর্ক স্থাপনের স্বতঃস্ফূর্ত ধারাকে** বোঝায়। এটি মূলত সামাজিক মনোবিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা।
* **উদাহরণ:** একটি নতুন ক্রিকেট দলের সদস্যরা প্রথম দিকে একে অপরকে জানে, এরপর নেতৃত্ব নিয়ে বা খেলার কৌশল নিয়ে কিছুটা দ্বন্দ্ব হয়, তারপর তারা খেলার নিয়ম মেনে নেয় এবং অবশেষে একসঙ্গে খেলতে শুরু করে। এটি স্বাভাবিক দলীয় প্রক্রিয়ার অংশ।
### দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া (Group Work Process)
**দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া** হলো সমাজকর্মের পেশাগত জ্ঞান, দক্ষতা ও নীতি প্রয়োগ করে **উদ্দেশ্যমূলকভাবে** দলীয় মিথস্ক্রিয়া ও পরিবেশ ব্যবহার করে সদস্যদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক ভূমিকা পালনের সক্ষমতা বিকাশের পদ্ধতি। এই প্রক্রিয়াটি সুনির্দিষ্টভাবে সমাজকর্মী দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত।
* **উদাহরণ:** মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে একই সমস্যা নিয়ে আসা ১০ জন ব্যক্তিকে সমাজকর্মী একটি দল তৈরি করে কাউন্সেলিং করছেন। এখানে প্রতিটি ধাপ একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিচালিত।
### দলীয় প্রক্রিয়া ও দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য
| ভিত্তি | দলীয় প্রক্রিয়া (Group Process) | দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া (Group Work Process) |
| :— | :— | :— |
| **১. প্রকৃতি ও স্বতঃস্ফূর্ততা** | এটি **স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাকৃতিক**। যেকোনো দল স্বাভাবিভাবেই এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। | এটি **পেশাদার ও উদ্দেশ্যমূলক**। সমাজকর্মী জ্ঞান ও দক্ষতার সাহায্যে পরিচালনা করেন। |
| **২. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য** | মূল লক্ষ্য হলো **দলীয় কাজ সম্পন্ন করা** বা সদস্যদের মধ্যে **পারস্পরিক বোঝাপড়া** তৈরি করা। | মূল লক্ষ্য হলো দলীয় পরিবেশকে ব্যবহার করে **ব্যক্তির বা দলের সমস্যার নিরাময়** এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনা। |
| **৩. পর্যায় বা ধাপসমূহ** | সাধারণত **টাকম্যানের মডেল** (গঠন, ঝঞ্ঝা, নিয়ম স্থাপন, কার্য সম্পাদন, বিলুপ্তি) অনুসরণ করে। | সুনির্দিষ্ট পেশাগত ধাপ অনুসরণ করে: প্রারম্ভিক অবস্থা, দল গঠন, হস্তক্ষেপ, মূল্যায়ন ও সমাপ্তি। |
| **৪. পরিচালনাকারী শক্তি** | **দলীয় আদর্শ (Norms), নেতৃত্ব ও সংহতি**। মূলত দলের অভ্যন্তরীণ শক্তি দ্বারা চালিত। | **পেশাদার সমাজকর্মী**। সমাজকর্মীর নীতিমালা, জ্ঞান ও মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। |
| **৫. ভিত্তি** | সামাজিক মনোবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান। | সমাজকর্মের নীতি ও মূল্যবোধ। |
| **৬. মূল ভূমিকা** | একজন সাধারণ **নেতা** বা দলের সদস্য। | একজন প্রশিক্ষিত **সুবিধাদানকারী (Facilitator)** ও সমস্যা নিরাময়কারী। |
**উপসংহার**
দলীয় প্রক্রিয়া হলো **কারণ**, আর দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া হলো সেই কারণকে পেশাগতভাবে ব্যবহার করার **কৌশল**। দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজকর্মী দলীয় মিথস্ক্রিয়ার শক্তিশালী শক্তিকে ব্যবহার করে প্রতিটি সদস্যের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনেন। যেখানে দলীয় প্রক্রিয়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে দলের অভ্যন্তরে সম্পর্ক তৈরি করে, সেখানে দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া পেশাগত নীতি ও উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হয়ে মানবিক ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে অবদান রাখে।
—
## ৪। ব্যক্তি সমাজকর্মের সংজ্ঞা দাও। ব্যক্তি সমাজকর্মের নীতিমালা আলোচনা কর।
**ভূমিকা**
**ব্যক্তি সমাজকর্ম (Social Casework)** হলো সমাজকর্মের সবচেয়ে পুরনো এবং মৌলিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে এটি সমস্যাগ্রস্ত একজন একক ব্যক্তিকে তার পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মানিয়ে চলতে সাহায্য করে। ব্যক্তি সমাজকর্ম ব্যক্তিকে তার সমস্যা সমাধানের জন্য **আত্মনির্ভরশীল** করে তুলতে মনো-সামাজিক জ্ঞান প্রয়োগ করে।
### ব্যক্তি সমাজকর্মের সংজ্ঞা
**ব্যক্তি সমাজকর্ম** হলো সমাজকল্যাণ সংস্থার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ব্যবহার করে সমস্যাগ্রস্ত **একক ব্যক্তিকে** তার পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে কার্যকরভাবে মানিয়ে চলতে সাহায্য করার একটি শিল্প ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। এটি ব্যক্তির সমস্যাকে তার মনস্তাত্ত্বিক দিক ও পরিবেশগত প্রভাবের আলোকে সামগ্রিকভাবে অনুধ্যান করে।
প্রখ্যাত সমাজকর্মী **হেলেব মিলনারের (Helen Harris Perlman)** মতে, “ব্যক্তি সমাজকর্ম হল একটি স্থানে সমস্যা নিয়ে আসা ব্যক্তির সাথে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া, যা তাকে সহায়তা করার জন্য ব্যবহৃত হয়।”
### ব্যক্তি সমাজকর্মের নীতিমালা
ব্যক্তি সমাজকর্মের সফল প্রয়োগ এবং পেশাগত মান নিশ্চিত করার জন্য কতগুলো সুনির্দিষ্ট নীতি বা মূল্যবোধ রয়েছে, যা সমাজকর্মীর আচরণ, ক্লায়েন্টের সঙ্গে সম্পর্ক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকে পরিচালনা করে। প্রখ্যাত সমাজকর্মী **ফেলিক্স পি. বিকেনস্টক (Felix P. Biestek)** এই নীতিমালাগুলো প্রণয়ন করেন। এই প্রধান নীতিমালাগুলো হলো:
#### ১. ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতার স্বীকৃতি (Recognition of Individualization)
এই নীতি অনুসারে, প্রতিটি ব্যক্তিকে **স্বতন্ত্র ও অদ্বিতীয়** হিসেবে দেখতে হবে। দুজন ব্যক্তির সমস্যা একই হলেও, তাদের কারণ, অনুভূতি, ব্যক্তিত্ব এবং সমাধানের পথ ভিন্ন হতে পারে। সমাজকর্মী প্রতিটি ক্লায়েন্টের জন্য তার **ব্যক্তিগত চাহিদা ও সামর্থ্য** অনুযায়ী ভিন্ন কৌশল ব্যবহার করবেন।
#### ২. উদ্দেশ্যমূলক ভাবাবেগ প্রকাশ (Purposeful Expression of Feeling)
ক্লায়েন্টকে তার **নেতিবাচক ও ইতিবাচক** সব ধরনের আবেগ ও অনুভূতি মুক্তভাবে প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। সমাজকর্মী তার অনুভূতি প্রকাশে উৎসাহিত করবেন এবং মনোযোগী শ্রোতা হিসেবে শুনবেন। আবেগ প্রকাশ সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ।
#### ৩. নিয়ন্ত্রিত আবেগিক সম্পৃক্ততা (Controlled Emotional Involvement)
সমাজকর্মীকে ক্লায়েন্টের সমস্যার প্রতি **সহানুভূতিশীল (Sympathy)** হতে হবে, তবে আবেগ দ্বারা **প্রভাবিত হওয়া যাবে না**। সমাজকর্মী আবেগিক সংবেদনশীলতার সঙ্গে ক্লায়েন্টের সমস্যা শুনবেন, কিন্তু নিজের পেশাগত নিরপেক্ষতা ও উদ্দেশ্য বজায় রাখবেন।
#### ৪. গ্রহণ ও স্বীকৃতি (Acceptance)
ক্লায়েন্টের **দোষ-ত্রুটি, দুর্বলতা, ব্যক্তিত্ব ও আচরণ**— যেমনই হোক না কেন, সমাজকর্মীকে তাকে **শর্তহীনভাবে** গ্রহণ করতে হবে। এই গ্রহণ বা স্বীকৃতি ক্লায়েন্টের প্রতি কোনো নৈতিক বা ব্যক্তিগত বিচার না করে তার আত্মমর্যাদা বজায় রাখে।
#### ৫. বিচার না করা (Non-Judgmental Attitude)
সমাজকর্মী কোনোভাবেই ক্লায়েন্টের সমস্যা, আচরণ বা তার পরিস্থিতির জন্য তাকে **দোষারোপ বা নৈতিক বিচার** করবেন না। সমাজকর্মীর দায়িত্ব হলো সমস্যার কারণ খুঁজে বের করা, বিচারক হওয়া নয়। এটি ক্লায়েন্টের মনে বিশ্বাস ও নির্ভরতা তৈরি করে।
#### ৬. আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার (Client Self-Determination)
সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার **অধিকার ক্লায়েন্টের নিজেরই**। সমাজকর্মী বিকল্পগুলো দেখাবেন, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবেন না। এই নীতি ক্লায়েন্টকে **ক্ষমতায়ন (Empowerment)** করে এবং তার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে।
#### ৭. গোপনীয়তা রক্ষা (Confidentiality)
ক্লায়েন্টের কাছ থেকে পাওয়া সমস্ত **ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল তথ্য** অবশ্যই গোপন রাখতে হবে। এই নীতি কেবল বিশেষ আইনি বাধ্যবাধকতা ছাড়া কখনো লঙ্ঘন করা উচিত নয়। গোপনীয়তা পেশাদার সম্পর্কের ভিত্তি এবং ক্লায়েন্টের বিশ্বাস ধরে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
**উপসংহার**
ব্যক্তি সমাজকর্মের এই নীতিমালাগুলো এই পেশাকে একটি **সুসংগঠিত, মানবিক ও নীতিগত** ভিত্তি প্রদান করে। এই নীতির কঠোর অনুসরণই নিশ্চিত করে যে সমাজকর্মী ক্লায়েন্টের সঙ্গে একটি শক্তিশালী পেশাদার সম্পর্ক তৈরি করতে পারবেন এবং ক্লায়েন্টকে তার নিজস্ব সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ সক্ষম করে তুলতে পারবেন।
—
## ৫। দলীয় গতিশীলতা কী? দলীয় গতিশীলতা আনয়নে সমাজকর্মীর ভূমিকা লিখ।
**ভূমিকা**
যখন একাধিক ব্যক্তি নিয়ে একটি দল গঠিত হয়, তখন সদস্যদের মধ্যে নানা ধরনের মিথস্ক্রিয়া তৈরি হয়। এই মিথস্ক্রিয়াগুলোর মাধ্যমে যে পরিবর্তনশীল শক্তি ও বল তৈরি হয়, তাকেই **দলীয় গতিশীলতা (Group Dynamics)** বলা হয়। দল সমাজকর্মের সফলতার জন্য এই গতিশীলতা একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। সমাজকর্মী তাঁর জ্ঞান ব্যবহার করে এই গতিশীলতা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করে দলের সদস্যদের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনেন।
### দলীয় গতিশীলতা কী?
**দলীয় গতিশীলতা** হলো একটি দলের অভ্যন্তরে সদস্যদের মধ্যেকার **পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া, সম্পর্ক, আচরণ এবং পরিবর্তনশীল শক্তিগুলোকে** অধ্যয়ন করার প্রক্রিয়া। এটি দেখায় যে কীভাবে একটি দল গঠিত হয়, কাজ করে, নেতৃত্ব সৃষ্টি করে, সংহতি তৈরি করে এবং সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দলীয় গতিশীলতার ধারণার জনক হিসেবে **কার্ট লেউইনকে (Kurt Lewin)** বিবেচনা করা হয়।
**দলীয় গতিশীলতার মূল উপাদানগুলো হলো:**
* **যোগাযোগ (Communication):** তথ্য ও অনুভূতির আদান-প্রদানের ধরন।
* **সংহতি (Cohesion):** দলের সদস্যদের মধ্যেকার আকর্ষণ ও একতার মাত্রা।
* **নেতৃত্ব (Leadership):** দলের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সদস্যদের প্রভাবিত করার প্রক্রিয়া।
* **দলীয় আদর্শ (Group Norms):** দলের সদস্যদের জন্য গৃহীত অলিখিত নিয়মকানুন।
### দলীয় গতিশীলতা আনয়নে সমাজকর্মীর ভূমিকা
দল সমাজকর্মের প্রধান লক্ষ্যই হলো দলের গতিশীলতাকে ব্যবহার করে সদস্যদের মধ্যে নিরাময় ও পরিবর্তন আনা। একজন সমাজকর্মী এই গতিশীলতা আনয়ন ও পরিচালনায় **সুবিধাদানকারী (Facilitator), শিক্ষাবিদ (Educator) ও পরামর্শদাতা (Counselor)** হিসেবে কাজ করেন।
#### ১. অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা
সমাজকর্মী শুরুতেই দলে একটি **নিরাপদ, বিশ্বাসযোগ্য ও আস্থার** পরিবেশ তৈরি করেন। এই অনুকূল পরিবেশই সদস্যদের মধ্যে মুক্ত আলোচনা, আবেগ প্রকাশ এবং আন্তঃব্যক্তিক মিথস্ক্রিয়ার জন্য গতিশীলতা সৃষ্টি করে। তিনি সদস্যদের ভয় বা দ্বিধা দূর করতে সাহায্য করেন।
#### ২. যোগাযোগ উৎসাহিত করা ও সমন্বয় সাধন
সমাজকর্মী দলের **যোগাযোগ ব্যবস্থাকে** শক্তিশালী করার জন্য কাজ করেন।
* তিনি নিশ্চিত করেন যে দলের সব সদস্য যেন সমানভাবে কথা বলার সুযোগ পায়।
* তিনি সদস্যদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হলে **মধ্যস্থতা** করেন এবং গঠনমূলক আলোচনায় উৎসাহিত করেন।
* তিনি নিজেই **খোলামেলা যোগাযোগের মডেল** হিসেবে কাজ করেন।
#### ৩. সংহতি ও একতা বৃদ্ধি
দলীয় সংহতি হলো দলের গতিশীলতার মূল চালিকাশক্তি। সমাজকর্মী বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে এই সংহতি বাড়ান।
* দলকে এমন **যৌথ লক্ষ্য** অর্জনে উৎসাহিত করেন, যা সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
* সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক **সহযোগিতামূলক কাজ (Cooperative tasks)** ও খেলাধুলার ব্যবস্থা করেন।
* সদস্যরা যেন একে অপরের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে পারে, সেই পরিস্থিতি তৈরি করেন।
#### ৪. নেতৃত্ব বিকাশ ও ব্যবহার
সমাজকর্মী দলের মধ্যে **নেতৃত্বের ধরন** পর্যবেক্ষণ করেন।
* তিনি নেতৃত্বকে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির হাতে না রেখে **গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের** মাধ্যমে দলের মধ্যে ছড়িয়ে দেন।
* তিনি নতুন নেতাদের **শনাক্ত** করেন এবং তাদের ইতিবাচক দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করেন, যাতে তারা দলের কার্যক্রমকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারে।
#### ৫. দ্বন্দ্ব নিরসন ও পুনর্গঠন
দলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক, যা দলীয় গতিশীলতার একটি অংশ। সমাজকর্মী এই **দ্বন্দ্বকে গঠনমূলক পথে চালিত করেন**।
* তিনি দ্বন্দ্বের সময় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন এবং সদস্যদের **গঠনমূলক সমালোচনার** মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছাতে সাহায্য করেন।
* তিনি **”ঝঞ্ঝা” (Storming)** পর্যায়টিকে নিয়ন্ত্রণ করেন, যাতে সদস্যরা হতাশ না হয়।
#### ৬. দলীয় আদর্শ (Norms) প্রতিষ্ঠায় সহায়তা
সমাজকর্মী দলের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে **ইতিবাচক দলীয় আদর্শ** তৈরি করতে সাহায্য করেন। এই আদর্শ (যেমন: সময় মেনে চলা, একে অপরের প্রতি সম্মান দেখানো) দলের প্রত্যাশিত আচরণের দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে এবং গতিশীলতাকে একটি নিয়মতান্ত্রিক রূপ দেয়।
**উপসংহার**
দলীয় গতিশীলতা হলো দল সমাজকর্মের **যন্ত্র**। একজন সমাজকর্মী তার পেশাগত দক্ষতা দিয়ে এই যন্ত্রটিকে এমনভাবে ব্যবহার করেন, যাতে দলের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিটি সদস্য তাদের ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান করতে পারে, সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে পারে এবং **সামাজিক ভূমিকা পালনের** সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। সমাজকর্মীর ভূমিকা ছাড়া এই গতিশীলতা নেতিবাচক বা লক্ষ্যহীন হতে পারত।
—
## ৬। সামাজিক গবেষণা তথ্য সংগ্রহের কৌশলগুলো আলোচনা কর।
**ভূমিকা**
**সামাজিক গবেষণা** হলো সমাজ ও মানুষের আচরণ সম্পর্কে নিয়মতান্ত্রিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া। গবেষণার ফলাফলকে নির্ভরযোগ্য করার জন্য প্রয়োজন নির্ভুল উপাত্ত বা তথ্য সংগ্রহ। **তথ্য সংগ্রহ (Data Collection)** হলো সুসংগঠিতভাবে উৎস থেকে প্রয়োজনীয় উপাত্ত আহরণের একটি বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া। তথ্য সংগ্রহের কৌশলগুলো প্রধানত তথ্যের উৎসের ওপর ভিত্তি করে **প্রাথমিক (Primary)** ও **মাধ্যমিক (Secondary)** দুই ভাগে বিভক্ত।
### তথ্যের উৎসের ভিত্তিতে কৌশল
#### ১. প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের কৌশলসমূহ
এই কৌশলগুলোর মাধ্যমে গবেষক **সরাসরি ক্ষেত্র থেকে** প্রথমবার তথ্য সংগ্রহ করেন, যা সাধারণত মৌলিক এবং গবেষণার উদ্দেশ্যের জন্য নির্দিষ্টভাবে তৈরি করা হয়।
##### ক. পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি (Observation)
পর্যবেক্ষণ হলো কোনো সামাজিক ঘটনা, ব্যক্তি বা দলের আচরণকে **সরাসরি এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে** মনোযোগ সহকারে দেখা ও লিপিবদ্ধ করার প্রক্রিয়া।
* **অংশগ্রহণমূলক:** গবেষক দলের সদস্য হিসেবে মিশে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন।
* **অনংশগ্রহণমূলক:** গবেষক দূর থেকে বা দলের বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করেন।
* **সুবিধা:** বাস্তব পরিবেশে তথ্য পাওয়া যায়, তথ্যদাতার মিথ্যা বলার সুযোগ কম থাকে।
##### খ. সাক্ষাৎকার পদ্ধতি (Interview)
সাক্ষাৎকার হলো মৌখিক প্রশ্ন-উত্তর বিনিময়ের মাধ্যমে তথ্যদাতার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করার পদ্ধতি। এটি সবচেয়ে প্রচলিত কৌশল।
* **কাঠামোগত:** প্রশ্নমালা পূর্বনির্ধারিত থাকে এবং সব তথ্যদাতাকে একই প্রশ্ন করা হয়।
* **অকাঠামোগত:** প্রশ্নমালা নমনীয় থাকে, আলোচনার মোড় অনুযায়ী প্রশ্ন পরিবর্তন করা যায়, যা গভীর তথ্য পেতে সাহায্য করে।
* **সুবিধা:** নিরক্ষর ব্যক্তির কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা যায়, জটিল বিষয়ে গভীর ধারণা পাওয়া যায়।
##### গ. প্রশ্নমালা পদ্ধতি (Questionnaire)
এটি লিখিত প্রশ্নের একটি তালিকা, যা উত্তরদাতা নিজেই পূরণ করেন। সাধারণত বেশি সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে অল্প সময়ের মধ্যে তথ্য সংগ্রহের জন্য এটি ব্যবহার করা হয়।
* **মেল (Mail) বা অনলাইন প্রশ্নমালা:** দূরত্বে থাকা তথ্যদাতার কাছে পাঠানো হয়।
* **সুবিধা:** তুলনামূলকভাবে কম খরচ ও কম সময়ে বিপুল সংখ্যক তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
##### ঘ. সূচি পদ্ধতি (Schedule)
প্রশ্নমালার মতোই লিখিত প্রশ্নাবলি থাকে, তবে এই ক্ষেত্রে গবেষক বা প্রশিক্ষিত তথ্য সংগ্রহকারী (Enumerator) নিজে প্রশ্ন করেন এবং উত্তরগুলো পূরণ করেন।
* **সুবিধা:** উত্তর সম্পূর্ণ ও নির্ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, তথ্যদাতার নিরক্ষরতা কোনো বাধা হয় না।
##### ঙ. ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন (FGD)
একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ৫ থেকে ১২ জনের একটি ছোট দলকে একত্রিত করে গবেষক যখন **দলীয় আলোচনা** পরিচালনা করেন, তখন তাকে FGD বলে। এটি কোনো বিষয়ে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি, আদর্শ বা সম্মিলিত মতামত জানতে সাহায্য করে।
#### ২. মাধ্যমিক তথ্য সংগ্রহের কৌশলসমূহ
এই কৌশলগুলোতে গবেষক সেই তথ্য ব্যবহার করেন, যা **ইতিমধ্যে অন্য কেউ সংগ্রহ করে প্রকাশ বা সংরক্ষণ করেছেন**।
##### ক. দাপ্তরিক দলিল (Official Documents)
বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি বা আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট, প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যান ব্যবহার করা।
* **উদাহরণ:** আদমশুমারি রিপোর্ট, বার্ষিক অর্থনৈতিক সমীক্ষা, সংস্থার কাজের রেকর্ড।
##### খ. অপ্রকাশিত দলিল (Unpublished Documents)
সাধারণের জন্য প্রকাশিত নয় এমন দলিল ব্যবহার করা।
* **উদাহরণ:** পিএইচডি থিসিস, অপ্রকাশিত গবেষণাপত্র, ডায়েরি, ব্যক্তিগত চিঠি।
##### গ. সাহিত্য পর্যালোচনা (Literature Review)
গবেষণার বিষয়বস্তু সম্পর্কিত বই, জার্নাল, ম্যাগাজিন ও সংবাদপত্র পর্যালোচনা করে তথ্যের মৌলিক ধারণা এবং পূর্ববর্তী গবেষণার অবস্থা জানা।
### কৌশল নির্বাচনের ভিত্তি
গবেষক তার প্রয়োজন অনুযায়ী এক বা একাধিক কৌশল সমন্বয় করে ব্যবহার করতে পারেন। কৌশল নির্বাচনের মূল ভিত্তিগুলো হলো: গবেষণার উদ্দেশ্য, গবেষণার প্রকৃতি (গুণগত বা পরিমাণগত), প্রাপ্য সময়, বাজেট এবং তথ্যদাতার ধরন।
**উপসংহার**
সামাজিক গবেষণার সফলতা বহুলাংশে নির্ভর করে সঠিক কৌশল প্রয়োগ করে নির্ভুল ও পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহের ওপর। এই কৌশলগুলো গবেষককে সমাজের জটিল বিষয়গুলো থেকে তথ্য আহরণ করে একটি বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে এবং সমাজকর্মের জ্ঞানভিত্তিক ভিত্তি সুদৃঢ় করতে সাহায্য করে।
—
## ৭। দল সমাজকর্ম কী? দল সমাজকর্মের নীতিমালা ও উপাদানগুলো আলোচনা কর।
**ভূমিকা**
**দল সমাজকর্ম (Social Group Work)** হলো সমাজকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি, যা ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। এই পদ্ধতি ছোট আকারের দলের পরিবেশ এবং সদস্যদের মধ্যেকার পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়াকে একটি **পেশাগত হাতিয়ার** হিসেবে ব্যবহার করে। দল সমাজকর্মের লক্ষ্য হলো দলীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সদস্যদের ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধান করা এবং তাদের সামাজিক ভূমিকা পালনের ক্ষমতাকে বিকশিত করা।
### দল সমাজকর্ম কী?
**দল সমাজকর্ম** হলো সমাজকর্মীর পেশাগত জ্ঞান, দক্ষতা ও মূল্যবোধ প্রয়োগ করে একটি ছোট দলের সদস্যদের মধ্যেকার **পারস্পরিক সম্পর্ক ও দলীয় প্রক্রিয়ার** মাধ্যমে তাদের সামাজিক কাজ করার দক্ষতা, মানসিক সক্ষমতা ও ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য সহায়তা করার প্রক্রিয়া।
**হ্যারী স. ট্র্যাকার (Harriett M. Bartlett)** দল সমাজকর্মকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে— “দল সমাজকর্ম হলো একটি প্রক্রিয়া, যেখানে দলীয় কাজকে সদস্যদের সামাজিক ভূমিকা পালনের ক্ষমতা বিকাশের জন্য ব্যবহার করা হয়।”
### দল সমাজকর্মের নীতিমালা
ব্যক্তি সমাজকর্মের মতো দল সমাজকর্মেরও কতগুলো সুনির্দিষ্ট নীতি রয়েছে, যা এর সফল প্রয়োগ নিশ্চিত করে। হ্যারী স. ট্র্যাকার এই নীতিগুলো প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। প্রধান নীতিগুলো নিম্নরূপ:
#### ১. উদ্দেশ্যমূলক দল গঠন (Purposeful Group Formation)
দল সমাজকর্ম শুরু হয় একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে। দল গঠনের সময় সদস্যদের **প্রয়োজনীয়তা, বয়স, আগ্রহ ও সমস্যা সমাধানের সামর্থ্যের** মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে দল তৈরি করতে হবে। উদ্দেশ্যহীনভাবে দল তৈরি করা যাবে না।
#### ২. দলের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নির্ধারণ (Specific Objective)
দল সমাজকর্মীর প্রধান কাজ হলো দলের সামগ্রিক উদ্দেশ্য এবং প্রতিটি সদস্যের **ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য** স্পষ্ট করে দেওয়া এবং তা অর্জনে সাহায্য করা। এই উদ্দেশ্য বাস্তবসম্মত ও পরিমাপযোগ্য হতে হবে।
#### ৩. উদ্দেশ্যমূলক কর্মী-দল সম্পর্ক (Purposeful Worker-Group Relationship)
সমাজকর্মী এবং দলের মধ্যেকার সম্পর্ক অবশ্যই **পেশাগত ও উদ্দেশ্যমূলক** হতে হবে। এই সম্পর্কটি ক্লায়েন্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে, কিন্তু ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের মতো নয়।
#### ৪. দলের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য (Group Individualization)
যদিও দল একটি একক সত্তা, তবুও সমাজকর্মীকে দলের **প্রতিটি সদস্যকে স্বতন্ত্রভাবে** দেখতে হবে এবং তাদের নিজস্ব গতি ও চাহিদা অনুযায়ী সাড়া দিতে হবে। একই সঙ্গে, দলটিকেও তার পরিবেশ ও ইতিহাসের নিরিখে একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে দেখতে হবে।
#### ৫. অবিচ্ছিন্ন মূল্যায়ন (Continuous Evaluation)
দলীয় কার্যক্রম চলাকালীন নিয়মিতভাবে এর **কার্যকারিতা ও অগ্রগতি** পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে কর্মপরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে।
#### ৬. আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার (Self-Determination)
দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সমস্যা সমাধানের কৌশল নির্ধারণে সদস্যদের **স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারকে** সম্মান জানাতে হবে। সমাজকর্মী কেবল বিকল্প ও তথ্য সরবরাহ করবেন।
#### ৭. অংশগ্রহণ (Participation)
সমাজকর্মীকে নিশ্চিত করতে হবে যে দলের **সকল সদস্য** যেন সক্রিয়ভাবে আলোচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে। সদস্যদের নিস্তেজতা বা নিষ্ক্রিয়তা দূর করার কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
### দল সমাজকর্মের উপাদানগুলো
দল সমাজকর্মের প্রক্রিয়াটিকে কার্যকরভাবে সম্পন্ন করার জন্য নিম্নলিখিত চারটি উপাদান অপরিহার্য:
১. **দল (The Group):** এটি হলো সেই ক্লায়েন্ট বা সাহায্যপ্রার্থী গোষ্ঠী, যাদের সমস্যা সমাধানে বা দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করা হবে। এটি একই সমস্যা, বয়স বা লক্ষ্যের ভিত্তিতে গঠিত হয়।
২. **স্থান বা সংস্থা (The Agency/Setting):** এটি হলো সেই সামাজিক কল্যাণ সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান, যার অধীনে সমাজকর্মী পেশাগত সেবা প্রদান করেন। এটিই সেবার কাঠামো ও সম্পদ সরবরাহ করে।
৩. **সমাজকর্মী (The Worker):** ইনি হলেন পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা সম্পন্ন ব্যক্তি, যিনি দলকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিচালিত করেন এবং দলীয় মিথস্ক্রিয়াকে ইতিবাচক দিকে চালিত করেন।
৪. **প্রক্রিয়া (The Process):** এটি হলো দলীয় গতিশীলতা ও মিথস্ক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে সদস্যদের লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করার ধারাবাহিক, নিয়মতান্ত্রিক ও পেশাদার ধাপসমূহ (যেমন: দল গঠন, হস্তক্ষেপ, মূল্যায়ন)।
**উপসংহার**
দল সমাজকর্ম একটি অত্যন্ত শক্তিশালী পদ্ধতি, যা দলীয় পরিবেশে ব্যক্তির নিরাময় ও বিকাশের সুযোগ তৈরি করে। এই নীতিমালা ও উপাদানগুলোর সুসমন্বিত প্রয়োগ সমাজকর্মীকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে (যেমন: হাসপাতাল, স্কুল, কিশোর সংশোধন কেন্দ্র) সফলভাবে দল সমাজকর্ম পদ্ধতি প্রয়োগ করতে সাহায্য করে।
—
## ৮। ব্যক্তি সমাজকর্ম কী? বাংলাদেশে ব্যক্তি সমাজকর্মের প্রয়োগক্ষেত্রগুলি আলোচনা করা।
**ভূমিকা**
**ব্যক্তি সমাজকর্ম (Social Casework)** সমাজকর্মের একটি প্রাথমিক এবং প্রাচীনতম পদ্ধতি, যা মূলত একক ব্যক্তির সমস্যা ও প্রয়োজনীয়তার ওপর আলোকপাত করে। এটি ব্যক্তির সমস্যাকে শুধু বাহ্যিক বা আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে, তার **মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক (Psycho-social)** দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে একটি পেশাগত সমাধান প্রদান করে।
### ব্যক্তি সমাজকর্ম কী?
**ব্যক্তি সমাজকর্ম** হলো সমাজকল্যাণমূলক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে পরিচালিত একটি পেশাগত প্রক্রিয়া, যা সমস্যাগ্রস্ত **একক ব্যক্তিকে** তার পরিবেশের সঙ্গে কার্যকরভাবে মানিয়ে চলতে, তার আত্মিক সক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলতে এবং তার সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে। এটি ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের জন্য তার ভেতরের সামর্থ্য ও বাইরের পরিবেশের সম্পদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।
### বাংলাদেশে ব্যক্তি সমাজকর্মের প্রয়োগক্ষেত্রসমূহ
বাংলাদেশে ব্যক্তি সমাজকর্মের ধারণাটি মূলত প্রাতিষ্ঠানিক সমাজসেবা এবং বিভিন্ন এনজিও (NGO)-এর কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এর প্রয়োগক্ষেত্রগুলো বেশ বিস্তৃত এবং দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত:
#### ১. চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা অঙ্গন (Medical and Health Setting)
* **হাসপাতাল সমাজসেবা:** সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে (যেমন— ঢাকা মেডিকেল কলেজ, হৃদরোগ হাসপাতাল) সমাজকর্মীরা রোগী ও তাদের পরিবারের **মানসিক চাপ, চিকিৎসার খরচ** বা চিকিৎসার পরবর্তী পুনর্বাসন সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে কাউন্সেলিং দেন।
* **দীর্ঘমেয়াদি রোগ:** এইডস, ক্যান্সার বা কিডনি ফেইলের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্তদের মানসিক শক্তি প্রদান ও অর্থনৈতিক সহায়তার উৎস খুঁজে দেওয়া।
#### ২. পরিবার ও শিশু কল্যাণ (Family and Child Welfare)
* **পারিবারিক সহিংসতা ও বিবাহবিচ্ছেদ:** পারিবারিক দ্বন্দ্ব নিরসনে মধ্যস্থতা, বিবাহবিচ্ছেদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের কাউন্সেলিং ও মানসিক সমর্থন দেওয়া।
* **এতিম ও দুস্থ শিশু:** সরকারি শিশু পরিবার বা এতিমখানায় শিশুদের পুনর্বাসন ও সামাজিকীকরণে সহায়তা করা।
* **শিশুশ্রম:** শিশুশ্রমিকদের ব্যক্তিগত কাউন্সেলিং দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা।
#### ৩. শিক্ষা ও বিদ্যালয় সমাজকর্ম (School Social Work)
* **শিক্ষার্থীর আচরণগত সমস্যা:** স্কুল থেকে ঝরে পড়া, স্কুলে অনুপস্থিতি, পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগিতা বা আচরণগত সমস্যার জন্য শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং দেওয়া।
* **অভিভাবক কাউন্সেলিং:** শিক্ষার্থীর সমস্যা সমাধানে শিক্ষক ও অভিভাবকের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করা।
#### ৪. সংশোধন ও বিচার ব্যবস্থা (Correctional and Judicial Setting)
* **কিশোর সংশোধন কেন্দ্র:** কিশোর অপরাধীদের ব্যক্তিগত কেস স্টাডি করে অপরাধের মূল কারণ নির্ণয় করা এবং তাদের সংশোধন ও সমাজে পুনর্বাসনের জন্য ব্যক্তিগত সহায়তা দেওয়া।
* **কারাগার:** সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের মানসিক চাপ কমানো, তাদের পরিবারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন এবং মুক্তির পর সমাজে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করা।
#### ৫. শিল্প ও কর্মসংস্থান (Industrial Setting)
* **শ্রমিক কল্যাণ:** শিল্প কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের ব্যক্তিগত ও কর্মক্ষেত্রের চাপ, আর্থিক সমস্যা, মাদকাসক্তি এবং শ্রম আইন সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে সহায়তা করা।
* **ব্যক্তিগত সমস্যা:** কর্মীর অনুপস্থিতি, দেরিতে আসার মতো সমস্যার পেছনে থাকা ব্যক্তিগত কারণগুলো খুঁজে বের করে সমাধান দেওয়া।
#### ৬. প্রবীণ কল্যাণ ও সামাজিক নিরাপত্তা (Geriatric and Social Security)
* **প্রবীণ নিবাস:** প্রবীণ নিবাসে বসবাসরত ব্যক্তিদের একাকীত্ব, মানসিক দুর্বলতা ও স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলায় ব্যক্তিগত কাউন্সেলিং দেওয়া।
* **সামাজিক নিরাপত্তা:** বিধবা ভাতা বা বয়স্ক ভাতার মতো সরকারি কর্মসূচির সুবিধা গ্রহণে দুস্থ ব্যক্তিদের সহায়তা করা।
**উপসংহার**
বাংলাদেশে ব্যক্তি সমাজকর্ম একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও কার্যকর পদ্ধতি। যদিও এর প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি এখনও সীমিত, তবুও বিভিন্ন সরকারি সমাজসেবা দপ্তর ও এনজিও-এর মাধ্যমে এটি দেশের কোটি কোটি সমস্যাগ্রস্ত মানুষের ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
—
৯। সমাজকর্ম গবেষণা কী? সমাজকর্মে সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব আলোচনা কর।
**ভূমিকা**
**সমাজকর্ম (Social Work)** একটি বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত পেশা। এর সকল কার্যক্রম, পদ্ধতি ও নীতিকে ভিত্তি দেওয়ার জন্য প্রয়োজন সুসংগঠিত এবং নিয়মতান্ত্রিক অনুসন্ধান। এই অনুসন্ধানের প্রক্রিয়াটিই হলো **সমাজকর্ম গবেষণা (Social Work Research)**। এটি সমাজকর্মের সেবাকে আবেগনির্ভর না করে প্রমাণভিত্তিক ও যুক্তিনির্ভর করে তোলে।
### সমাজকর্ম গবেষণা কী?
**সমাজকর্ম গবেষণা** হলো সমাজকর্মের সুনির্দিষ্ট জ্ঞান, দক্ষতা, পদ্ধতি এবং ফলাফল সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন এবং সমাজকর্মীদের পেশাগত দক্ষতা ও সেবার মান উন্নয়নের জন্য পরিচালিত **সুসংগঠিত, বৈজ্ঞানিক ও ফলিত অনুসন্ধান**। এটি মূলত সামাজিক গবেষণার একটি বিশেষায়িত রূপ, যা সমাজকর্ম পেশার বাস্তব সমস্যা সমাধানে সরাসরি মনোযোগ দেয়।
সংক্ষেপে, এটি সমাজকর্মের **কাজ, পদ্ধতি ও ফলাফল** সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন ও যাচাই করার একটি প্রক্রিয়া।
### সমাজকর্মে সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব
সমাজকর্মের পেশাগত ও কার্যকর ভূমিকা পালনের জন্য সামাজিক গবেষণা অপরিহার্য। এর গুরুত্বগুলো নিম্নরূপ:
#### ১. সমস্যা শনাক্তকরণ ও গভীরতা নির্ণয়
সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে সমাজকর্মীরা সমাজের জটিল সমস্যাগুলোর (যেমন: দারিদ্র্য, মাদকাসক্তি, লিঙ্গ বৈষম্য) **মূল কারণ, প্রকৃতি ও প্রভাব** গভীরভাবে জানতে পারেন। গবেষণার ফলাফল সমাজকর্মীকে সমস্যা সমাধানের জন্য সঠিক কৌশল নির্ধারণে সহায়তা করে।
#### ২. সেবার কার্যকারিতা ও ফলাফল যাচাই
সমাজকর্মের বিভিন্ন কৌশল বা কর্মসূচি (যেমন: কাউন্সেলিং, প্রশিক্ষণ) বাস্তবে কতটা সফল হচ্ছে এবং কাঙ্ক্ষিত ফল আনছে কিনা, তা **বৈজ্ঞানিকভাবে মূল্যায়ন** করার জন্য গবেষণা অপরিহার্য। এর মাধ্যমে দুর্বল কর্মসূচিগুলো চিহ্নিত করা এবং কার্যকর কৌশলগুলোকে শক্তিশালী করা সম্ভব হয়।
#### ৩. নতুন জ্ঞান ও তত্ত্বের বিকাশ
গবেষণা সমাজকর্মের জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে। **ব্যক্তি সমাজকর্ম বা দল সমাজকর্মের** মতো মৌলিক পদ্ধতিগুলোর জন্য নতুন কৌশল বা তত্ত্ব উদ্ভাবন করতে গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি সমাজকর্মকে একটি **গতিশীল ও উন্নতশীল পেশা** হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
#### ৪. পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সম্পদ আহরণ
সামাজিক গবেষণার তথ্য (যেমন: নির্দিষ্ট এলাকায় কতজন সুবিধাভোগী আছে, তাদের চাহিদা কী) ব্যবহার করে সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলো **বাস্তবসম্মত লক্ষ্য, বাজেট ও পরিকল্পনা** প্রণয়ন করতে পারে। এই তথ্য দাতা সংস্থা ও সরকারের কাছ থেকে **তহবিল ও সম্পদ** আহরণেও সাহায্য করে।
#### ৫. পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি
গবেষণার ফলাফল সমাজকর্মীদের পেশাগত দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের চাহিদা নির্ধারণ করে। নতুন কৌশল ও প্রমাণের ভিত্তিতে সমাজকর্মীরা তাদের কাজকে আরও উন্নত করতে পারে, যা **পেশাদারিত্ব** বাড়ায়।
#### ৬. জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ
জনগণের অর্থে পরিচালিত সমাজকল্যাণমূলক সংস্থাগুলোর কাজের জন্য **জবাবদিহি (Accountability)** নিশ্চিত করা জরুরি। গবেষণা ফলাফলের মাধ্যমে সংস্থাগুলো তাদের সফলতা বা ব্যর্থতা প্রকাশ করে জনসমক্ষে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে পারে।
#### ৭. সামাজিক নীতি ও আইন পরিবর্তন
যখন গবেষণা প্রমাণ করে যে কোনো আইন বা নীতি সমাজের জন্য ক্ষতিকর বা বৈষম্যমূলক, তখন সেই গবেষণার ফল ব্যবহার করে **সামাজিক কার্যক্রমের** মাধ্যমে আইন বা নীতি পরিবর্তনের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যায়। এটি সমাজকর্মের **সামাজিক সংস্কারের** ভূমিকাকে শক্তিশালী করে।
**উপসংহার**
সামাজিক গবেষণা হলো সমাজকর্মের সকল কার্যক্রমের **মেরুদণ্ড**। এটি সমাজকর্মকে শুধুমাত্র একটি মানবতাবাদী কর্ম থেকে একটি **বিজ্ঞানভিত্তিক, প্রমাণ-নির্ভর ও পেশাদার** সেবায় রূপান্তরিত করে। গবেষণা ছাড়া সমাজকর্ম একটি অনুমাননির্ভর ও দুর্বল পেশা হিসেবে থেকে যেত।
—
## ১১। এইচ, এইচ পার্লম্যানের উক্তির আলোকে ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদান গুলো ব্যাখ্যা কর।
**ভূমিকা**
**ব্যক্তি সমাজকর্মের (Social Casework)** তাত্ত্বিক ভিত্তি গঠনে **হেলেব হ্যারিস পার্লম্যানের (Helen Harris Perlman)** অবদান অনস্বীকার্য। তার প্রণীত সুপরিচিত সূত্রটি ব্যক্তি সমাজকর্মের মৌলিক উপাদানগুলোকে এক সরল বাক্যে প্রকাশ করে। এই সূত্রটি ব্যক্তি সমাজকর্মের প্রক্রিয়াটিকে বিশ্লেষণ করার একটি কার্যকর কাঠামো প্রদান করে, যা সমাজকর্মের অনুশীলনকে সহজ ও বোধগম্য করে তোলে।
### পার্লম্যানের উক্তি ও মূলসূত্র
পার্লম্যানের বিখ্যাত উক্তিটি হলো:
> **”ব্যক্তি সমাজকর্ম হল একটি স্থানে (Place) সমস্যা (Problem) নিয়ে আসা ব্যক্তির (Person) সাথে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া (Process), যা তাকে সহায়তা করার জন্য ব্যবহৃত হয়।”**
> *(“Casework is a process used by certain social welfare agencies to help individuals with a problem that they bring to the place.”)*
এই উক্তিটির বিশ্লেষণ করলে ব্যক্তি সমাজকর্মের চারটি মৌলিক উপাদান পাওয়া যায়, যা সংক্ষেপে **৪-P (Four P’s)** নামে পরিচিত:
### পার্লম্যানের উক্তির আলোকে উপাদানসমূহের ব্যাখ্যা
#### ১. ব্যক্তি (The Person)
পার্লম্যানের দৃষ্টিতে, **ব্যক্তি** হলেন সমাজকর্মের কেন্দ্রে থাকা সাহায্যপ্রার্থী। সমাজকর্মীকে শুধু সমস্যার ওপর মনোযোগ না দিয়ে সমস্যাগ্রস্ত **ব্যক্তির ওপর** মনোযোগ দিতে হবে।
* **বিশ্লেষণ:** এই ব্যক্তি তার নিজস্ব পরিবেশ, ইতিহাস, সংস্কৃতি, আবেগ ও সামর্থ্য নিয়ে আসে। সমাজকর্মীর কাজ হলো ব্যক্তির এই **স্বাতন্ত্র্যকে** সম্মান করা এবং তার **অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে** জাগিয়ে তোলা, যাতে সে নিজেই নিজের সমস্যার সমাধানে অংশ নিতে পারে।
#### ২. সমস্যা (The Problem)
**সমস্যা** হলো সেই জটিলতা বা প্রয়োজন, যা ব্যক্তিটিকে কষ্ট দিচ্ছে এবং যার জন্য সে সমাজকর্মীর কাছে সাহায্য চাইতে এসেছে।
* **বিশ্লেষণ:** সমস্যাকে অবশ্যই ব্যক্তির **মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক** দিক থেকে বিশ্লেষণ করতে হবে (মনো-সামাজিক অনুধ্যান)। সমাজকর্মী ব্যক্তিকে বুঝতে সাহায্য করবেন যে সমস্যাটি আসলে কী এবং এর পেছনের কারণগুলো কী। পার্লম্যানের মতে, সমস্যাটি যেন ব্যক্তির **সীমার মধ্যে** থাকে, অর্থাৎ ব্যক্তি যেন তা সমাধানে অংশ নিতে পারে।
#### ৩. স্থান/সংস্থা (The Place)
**স্থান** বলতে সেই সামাজিক কল্যাণ সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে বোঝায়, যার মাধ্যমে পেশাদার সমাজকর্মের সেবা প্রদান করা হয়।
* **বিশ্লেষণ:** স্থান বা সংস্থাটি সমাজকর্মের নীতি, নিয়মকানুন ও মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়। এটি ক্লায়েন্ট ও সমাজকর্মীর মধ্যে **পেশাদার সম্পর্ক** স্থাপনের একটি কাঠামোগত পরিবেশ দেয়। সংস্থাই প্রয়োজনীয় অর্থ, কর্মী ও সম্পদ সরবরাহ করে এবং সেবার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করে।
#### ৪. প্রক্রিয়া (The Process)
**প্রক্রিয়া** হলো সমাজকর্মী এবং ক্লায়েন্টের মধ্যেকার সেই **সুনির্দিষ্ট, ধারাবাহিক ও উদ্দেশ্যমূলক মিথস্ক্রিয়া**, যা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়।
* **বিশ্লেষণ:** এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে মনো-সামাজিক অনুধ্যান, সমস্যা চিহ্নিতকরণ, কর্মপরিকল্পনা তৈরি, হস্তক্ষেপ এবং চূড়ান্ত মূল্যায়ন। এই প্রক্রিয়াই নিশ্চিত করে যে সহায়তাটি এলোমেলো না হয়ে একটি **বিজ্ঞানসম্মত ও পেশাগত** পদ্ধতিতে দেওয়া হচ্ছে।
### অতিরিক্ত উপাদান (Worker and Relationship)
পার্লম্যান পরবর্তীকালে এই ৪-P এর সাথে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানকে গুরুত্ব দেন:
* **সমাজকর্মী (The Worker):** যিনি তার জ্ঞান, নীতি ও দক্ষতা দিয়ে প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করেন।
* **পেশাদার সম্পর্ক (The Relationship):** সমাজকর্মী ও ক্লায়েন্টের মধ্যে গড়ে ওঠা পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থার এবং উদ্দেশ্যমূলক সম্পর্ক।
**উপসংহার**
এইচ. এইচ. পার্লম্যানের সূত্রটি ব্যক্তি সমাজকর্মের একটি **সংক্ষিপ্ত ও শক্তিশালী নীলনকশা** প্রদান করে। এই ৪-P উপাদানগুলো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া তৈরি করে, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিকে তার মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক পরিবেশে পুনরায় সুপ্রতিষ্ঠিত করা এবং তাকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলা।
—
## ১২। সামাজিক কার্যক্রম কী? সামাজিক কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।
**ভূমিকা**
**সামাজিক কার্যক্রম (Social Action)** সমাজকর্মের একটি মাধ্যমিক বা সহায়ক পদ্ধতি, যা ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত সমস্যার পরিবর্তে সমাজের কাঠামোগত সমস্যাগুলোর ওপর মনোযোগ দেয়। যখন কোনো ব্যক্তির সমস্যা সমাজের **ত্রুটিপূর্ণ আইন, নীতি বা বৈষম্যমূলক কাঠামোর** ফল হয়, তখন সমাজকর্মীরা কেবল ব্যক্তিকে নিরাময় না করে, সেই কাঠামোটাই পরিবর্তনের জন্য সামাজিক কার্যক্রম পদ্ধতিটি ব্যবহার করেন।
### সামাজিক কার্যক্রম কী?
**সামাজিক কার্যক্রম** হলো সমাজকর্মী ও সমাজের সচেতন জনগণের সমন্বয়ে পরিচালিত একটি সুসংগঠিত প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে **সামাজিক অন্যায়, বৈষম্য বা ত্রুটিপূর্ণ আইন ও নীতির বিরুদ্ধে** সমষ্টিগতভাবে লড়াই করে সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য কাঠামোগত ও মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়।
প্রখ্যাত সমাজকর্মী **এস. এল. ফ্যাল্ক (S. L. Falk)** এর মতে, “সামাজিক কার্যক্রম হলো সামাজিক পরিবর্তন আনয়ন এবং সমাজকে একটি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে চালিত করার প্রচেষ্টা।”
### সামাজিক কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা
সামাজিক কার্যক্রম সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদ্ধতি। এর প্রধান প্রয়োজনীয়তাগুলো নিম্নরূপ:
#### ১. কাঠামোগত সমস্যা সমাধান
ব্যক্তি সমাজকর্ম কেবল সমস্যার **বাহ্যিক প্রকাশ (Symptom)** নিয়ে কাজ করে। কিন্তু দারিদ্র্য, বৈষম্য, জাতিগত নিপীড়ন বা জেন্ডার বৈষম্যের মতো সমস্যাগুলোর মূলে থাকে সমাজের **গভীর কাঠামো ও নীতিগত দুর্বলতা**। এই কাঠামোগত কারণগুলো দূর করতে সামাজিক কার্যক্রম অপরিহার্য।
#### ২. সামাজিক ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠা
সামাজিক কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হলো সমাজের প্রান্তিক ও দুর্বল জনগোষ্ঠী (যেমন— প্রতিবন্ধী, দরিদ্র, নারী, আদিবাসী) যাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তাদের জন্য **সামাজিক ন্যায় (Social Justice)** প্রতিষ্ঠা করা। এই পদ্ধতি অধিকার আদায়ের জন্য দর কষাকষি ও চাপ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
#### ৩. সামাজিক নীতি ও আইন সংস্কার
ত্রুটিপূর্ণ বা অপ্রয়োজনীয় আইন ও নীতিগুলো (যেমন— পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত শিথিল আইন, শ্রম আইন) সমাজের সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। সামাজিক কার্যক্রম **জনমত তৈরি, লবিং ও জনসমাবেশের** মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এই নীতিগুলো সংশোধন বা নতুন জনমুখী নীতি প্রণয়নে বাধ্য করে।
#### ৪. জনগণের ক্ষমতায়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধি
এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণ নিজেদের অধিকার ও সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হয়। তারা **সংগঠিত হতে** এবং নিজেদের জন্য আওয়াজ তুলতে শেখে। এটি জনগণের মধ্যে **আত্মবিশ্বাস ও সক্ষমতা (Empowerment)** বৃদ্ধি করে, যা গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।
#### ৫. সমাজের স্থিতাবস্থা ভাঙা
বহু শতাব্দী ধরে চলে আসা সামাজিক অন্যায় বা বৈষম্য (যেমন— অস্পৃশ্যতা বা জেন্ডার বৈষম্য) সমাজের স্থিতাবস্থার কারণে সহজে ভাঙে না। সামাজিক কার্যক্রম একটি **গতিশীল ও চ্যালেঞ্জিং শক্তি** হিসেবে এই স্থিতাবস্থা ভেঙে সমাজের প্রগতিশীল পরিবর্তন নিশ্চিত করে।
#### ৬. সমাজকর্মের নিরাময়মূলক ভূমিকা সম্প্রসারণ
যখন একজন সমাজকর্মী দেখেন যে তার ক্লায়েন্টের সমস্যা বারবার ফিরে আসছে, কারণ সমাজের মূল কাঠামো ঠিক হচ্ছে না, তখন তিনি **সামাজিক কার্যক্রমের** দিকে মনোনিবেশ করেন। এটি সমাজকর্মকে নিছক ব্যক্তিগত নিরাময়কারী থেকে সমাজের একজন **সংস্কারক ও পরিবর্তনের কর্মী** হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
**উপসংহার**
সামাজিক কার্যক্রম হলো একটি **বৃহত্তর সামাজিক প্রকৌশল**। এটি কেবল ব্যক্তিগত সমস্যার উপশম না করে, বরং সমস্যার জন্ম দেওয়া সমাজ ব্যবস্থার মূলে আঘাত হানে। সামাজিক উন্নয়ন, মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার জন্য সামাজিক কার্যক্রম একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও কার্যকর পদ্ধতি।